সহায়: মেয়েকে সম্বল করে পথে অভিজিৎ ও মন্দিরা। পাশে সুনীতা এবং আলমগির। নিজস্ব চিত্র।
মেয়েটির বয়স সবে সাড়ে পাঁচ বছর। কিন্তু সে-ই যেন অভিভাবক!
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে পেশা বদলে গিয়েছে অভিজিৎ ধীবর এবং তাঁর স্ত্রী মন্দিরার। পান্ডুয়ার সিমলাগড়ের জন্মান্ধ ওই দম্পতি আগে লোকাল ট্রেনে ধূপকাঠি বিক্রি করতেন। ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভিক্ষা করতে নামলেন শুক্রবার থেকে। কিন্তু রাস্তা চিনবেন কী করে? অভিভাবকের মতো তাঁদের হাত ধরেছে একরত্তি মেয়ে মৌমিতা।
ট্রেনে চড়া অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল ওই দম্পতির। কিন্তু রাস্তা অচেনা। মৌমিতাই পথ দেখাচ্ছে। কোন দোকানে যেতে হবে, রাস্তার কোন ধার দিয়ে চলতে হবে, সে-ই ঠিক করছে। তার কাঁধ ছুঁয়ে এগোচ্ছেন অভিজিৎ-মন্দিরা। তাঁদের সঙ্গে একই পথের পথিক হয়েছেন দৃষ্টিশক্তিহীন আরও দুই পড়শি— সুনীতা চট্টোপাধ্যায় এবং আলমগির।
শুক্রবার দুপুরে ওই পাঁচ জনকে দেখা গেল চুঁচুড়ার বিভিন্ন রাস্তায়। কাঁধ থেকে ঝোলানো সাউন্ড-বক্সে গান গেয়ে ভিক্ষা করছিলেন অভিজিৎ। ভূপেন হাজারিকার গান। ‘মানুষ মানুষের জন্য...’। গলা মেলাচ্ছিলেন বাকি তিন জন।
মৌমিতার দু’চোখ ভরা কৌতূহল। কত দোকান! কত জিনিস! কেউ কেউ তার হাতেও টাকা-পয়সা দিচ্ছিলেন। কারও দেওয়া চকোলেট ছিল ছোট্ট হাতে। চুঁচুড়ার ঘড়ির মোড় এলাকায় এক বস্ত্র ব্যবসায়ী নতুন জামা দিলেন। মৌমিতার আনন্দ ধরে না! এক ব্যবসায়ী রান্নাবাটি খেলার সরঞ্জামও দিতেই শিশুটির একমুখ হাসি!
অভিজিৎ জানান, ট্রেনে ধূপকাঠি বিক্রি করতে সমস্যা হতো না। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী এক কামরা থেকে অন্য কামরায় ঠিক উঠে পড়তেন। কিন্তু রাস্তায় ঘুরে ভিক্ষা করেননি কখনও। তাই মেয়েকে সঙ্গে নিয়েছেন। গত বছর লকডাউনে মেয়ে ছোট ছিল। তখন বেরোননি। ঘরেই ছিলেন। এ বারও সে ভাবেই কাটবে ভেবেছিলেন। কিন্তু জমানো টাকা শেষ। তাই পথে নামতে হয়েছে।
এ দিন রেলকর্মীদের জন্য বিশেষ ট্রেনে চড়ে সকালে পাঁচ জনে চুঁচুড়ায় নামেন। তারপরেই শুরু হয় ভিক্ষা। দুপুরে পৌঁছন ঘড়ির মোড়ে। অভিজিতের কথায়, ‘‘আমাদের আর কে খেতে দেবে? বাধ্য হয়েই মেয়ের দৃষ্টিশক্তিকে পাথেয় করে পথে নামতে হয়েছে।’’
ঘড়ির মোড়ে বস্ত্র ব্যবসায়ী উজ্জ্বল দাস একরত্তি মেয়েটিকে ভুলতে পারছিলেন না। ভুলতে পারছিলেন না দৃষ্টিশক্তিহীন ওই চার জনের কথাও। তাঁর আফশোস, ‘‘এক করোনা কী করে দিল! ব্যবসা লাটে উঠেছে। মানুষ মারা যাচ্ছেন। দু’মুঠো ভাতের জন্য ওইটুকু একটা মেয়েকেও পথে পথে ঘুরতে হচ্ছে এই গরমে!’’