দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে... রানার আর নেই। মোবাইল ফোনের যুগে চিঠি লেখার চলও কার্যত হারিয়েছে। সেই সব স্মৃতি হুগলির শ্রীরামপুরের শিবতলা লেন সর্বজনীনের পুজো ভাবনায়। —নিজস্ব চিত্র।
চিঠি লেখা হারানো শিল্প! নয়া প্রযুক্তিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মিনিটের মধ্যে চিঠি লেখা যায়। ইন্টারনেটের সাহায্যে নিমেষে তা পৌঁছনো যায় প্রাপকের মুঠোয়। এক সময় চিঠির বোঝা পিঠে ছুটেছেন রানার। পরে ডাকঘরের মাধ্যমে চিঠি চালাচালি হয়েছে। হাতে লেখা চিঠির সুদিনের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে শ্রীরামপুর শহরের শিবতলা সর্বজনীন। মডেলের মাধ্যমে রয়েছে রানার, পিয়োন, ট্রাঙ্ক কল, ডাকঘরের কাজ।
দুর্গাপুজোর আয়োজনে হুগলি জুড়েই থিমের ছড়াছড়ি। চুঁচুড়ার বাবুগঞ্জ সর্বজনীনের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে প্লাস্টিকের তেলের জার, ভাঙা বালতি, রংয়ের কৌটো প্রভৃতি দিয়ে। পুজো কমিটির মুখ্য উপদেষ্টা জয়দেব অধিকারী বলেন, ‘‘প্লাস্টিকের পুর্নব্যবহার না হলে, মানব সভ্যতা ধ্বংসের দিকে এগোবে।’’ প্রতাপপুর সর্বজনীনের থিম ‘স্বপ্নের তরী’। নৌকার আদলে তৈরি মণ্ডপ টিস্যু পেপার, মশারি, মাছ ধরার জাল দিয়ে সাজানো। রথতলা সর্বজনীনের মণ্ডপে ইলাহাবাদের রাজবাড়ির আদল। ভিতরে নাটমন্দির। মতিবাগান সর্বজনীনের ভাবনায় চন্দ্রযান। চাঁদের মাটিতেই প্রতিমা। পঞ্চাননতলা সর্বজনীন ফরাসি পোস্টম্যান ফার্দিনান্দ শেভেলের মৃত্যুর শতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর তৈরি ‘আইডিয়াল প্যালেস’-এর আদলে মণ্ডপ করেছে বালু-ভাস্কর্য দিয়ে। প্রতিমাও বালি দিয়ে তৈরি। শান্তিপল্লি সর্বজনীন আঁকড়ে ধরেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। থিম— সহজপাঠ।
আরামবাগের সুদেবপুর স্পোর্টস ক্লাবের থিম ‘বর্ণপরিচয়’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজপাঠের ছোট ছোট বাক্যের চিত্র ফুটিয়ে তোলা শিল্পী নন্দলাল বসুর বর্ণপরিচয় দিয়ে সাজানো হয়েছে মণ্ডপ। দুই পুজোর কর্মকর্তাদেরই বক্তব্য, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের রমরমার মধ্যে শৈশবের সহজপাঠ কচিকাঁচারা ভুলতে বসেছে। তাই এই থিম। বড়রা নিজেদের ছোটবেলার স্মৃতি খুঁজে পাবেন।
সুস্থ-সুন্দর সমাজ গড়ার বার্তা দিয়ে আরামবাগের ২-এর পল্লির থিম ‘আয়নায় মা দুর্গা’। ৩-এর পল্লিতে ‘পাখিরালয়’, মানিক সঙ্ঘে পাহাড়ি শহরে শান্ত হিল স্টেশনে সুন্দর পরিবেশ গড়ার ডাক। ধান্যগোড়ির মা দুর্গা সেবা সঙ্ঘর থিমে উঠে এসেছে ‘নির্মল গ্রাম’। দৌলতপুর যুবশক্তি নাট্যমন্দির গোষ্ঠীর থিম ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ’। খানাকুলের ঘোষপুর শিক্ষাকেন্দ্র এবং গ্রামবাসীবৃন্দের থিম ‘ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের পুনরুজ্জীবন এবং প্লাস্টিক-থার্মোকল বর্জন’। পলাশপাই তরুণ দলের পুজোয় দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ার আহ্বান। পুরশুড়া, গোঘাট, আরামবাগ ব্লক এলাকার বিভিন্ন পুজোয় প্রাচীন মন্দির, তীর্থস্থান, চন্দ্রযান ৩, বিশ্বকাপ ইত্যাদির মডেল বা আদল।
হারিয়ে যাচ্ছে নদ-নদী। বিলুপ্ত হচ্ছে মাছ, অন্যান্য জলজ প্রাণী। প্লাস্টিকে-বন্দি খাল-পুকুর। মাটির নীচের জলস্তর নামছে প্রতিদিন। সব মিলিয়ে ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রকৃতি। বিষয়টি সামনে এসেছে উত্তরপাড়ার ভদ্রকালী বলাকার পুজো ভাবনায়। থিমের নাম, ‘ধারা যাপন’। শিল্পী অরিজিৎ পাল ও নির্মল বারিক তুলে ধরেছেন দৈনন্দিন জীবনে প্রকৃতির উপরে মানুষের নির্মমতার জলছবি। উত্তরপাড়া আপনজনের শোলার সাজের প্রতিমা দৃষ্টিনন্দন। ইয়ং স্টারের পুজোয় ইস্কনের চন্দ্রোদয় মন্দির। মাখলা বিবেকানন্দ সঙ্ঘে কেরলে লোকশিল্পের আঙ্গিক। কোন্নগরের দক্ষিণপাড়া সর্বজনীনের মণ্ডপে ধামসা-মাদলের শব্দ। সেই তালে গান, নাচ। ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূমের আদিবাসী গ্রামের ছবি তুলে ধরা হয়েছে এখানে।
শ্রীরামপুরের চাতরা, তারাপুকুর, মাহেশের বিভিন্ন পুজোয় হরেক থিম। নিউগেট সর্বজনীনের থিম ‘বাংলার ঐতিহ্য’। তারাপুকুর ২৮-এর পল্লিতে এক টুকরো গ্রাম। নতুনপাড়া মহিলাবৃন্দের থিম, ‘এসো মা লক্ষ্মী’। ১৯-এর পল্লি, জগন্নাথ ঘাট লেন (লক্ষ্মীঘাট) প্রভৃতি পুজোতেও রয়েছে থিম। সাথী সঙ্ঘে রয়েছে পটচিত্রের বাহার। ভাগীরথী লেনের (ভিতরের মাঠ) পুজোয় মণ্ডপ কর্নাটকের বিধানসভার আদলে। মাহেশ কলোনি সর্বজনীনে বৃন্দাবনের পাগলাবাবার মন্দির, ৫ ও ৬ এর পল্লিগোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী সমিতিতে বৃন্দাবনের প্রেম মন্দিরের আদলে মণ্ডপ। কোন্নগর মনসাতলা সর্বজনীের এ বার সুবর্ণ জয়ন্তী। থিম— কুমোরটুলির আদলে পটুয়াপাড়ার পাঁচালি।
রাজপথ থেকে অলিগলি সেজেছে বাহারি আলোয়। কানে বাজছে ঢাকের ঢ্যাম-কুড়াকুড় বাদ্যি।