‘লাইব্রেরি লাভার্স’-এর সদস্যেরা। নিজস্ব চিত্র
রাজ্যের আর পাঁচটি গ্রন্থাগারের মতো কর্মীসঙ্কট চলছে সার্ধ-শতবর্ষের চন্দননগর পুস্তকাগারেও। তবে, স্থানীয় বইপ্রেমীদের জন্য তাতে বিশেষ আঁচ পড়ছে না। তাঁদের হাত ধরেই বই লেনদেন, পুস্তকাগারে বসে পড়া চলছে। স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়া এই বইপ্রেমীদের নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘লাইব্রেরি লাভার্স’ দল। দলের অনেকেই মহিলা।
কর্তৃপক্ষ জানান, ১৮৭৩ সালের পয়লা অক্টোবর এই পুস্তকাগার তৈরি হয় শহরের উর্দিবাজারে একটি ভাড়াবাড়িতে। তখন এখানে ফরাসিদের উপনিবেশ। পরে স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা চন্দননগরের প্রথম মেয়র হরিহর শেঠ তাঁর বাবা নৃত্যগোপাল শেঠের নামে শহরের বাগবাজারে একটি সাংস্কৃতিক মঞ্চ (নৃত্যগোপাল স্মৃতিমন্দির) এবং লাগোয়া এই পুস্তকাগার তৈরি করেন। শিক্ষাবিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা ছিল হরিহরের।
পুস্তকাগারের দেড়শো বছর পূর্তির উদ্বোধন হয় গত পয়লা অক্টোবর। সম্প্রতি পদযাত্রা হয়। কর্তৃপক্ষ জানান, চলতি বছরে আরও নানা অনুষ্ঠান হবে।
এই স্মৃতিমন্দির ও পুস্তকাগার প্রাচীন শহরের ঐতিহ্যের তালিকায় অন্যতম। গ্রন্থাগারিক সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডক্টর সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো বহু খ্যাতিমান মানুষ এখানে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা করে গিয়েছেন।
পুস্তকাগারে বইয়ের সংখ্যা ৭০ হাজারের আশপাশে। তার মধ্যে প্রায় ৩১ হাজার দুষ্প্রাপ্য বই। ফরাসি আমলের অনেক সাহিত্য সম্ভার আছে। তুলোট কাগজের উপরে লেখা অনেক পুঁথিও রয়েছে, যা তৎকালীন সময় ও সমাজ দর্শনকে তুলে ধরে। সেই আমলের হাতে লেখা অনেক পত্রিকাও আছে। রয়েছে বহু প্রাচীন দৈনিক সংবাদপত্র, পঞ্জিকা। এই রাজ্য তথা দেশের বিভিন্ন জায়গার পাশাপাশি ফ্রান্স, বাংলাদেশ-সহ নানা দেশ থেকে গবেষক, অধ্যাপক এই পুস্তকাগারে আসেন তথ্য সংগ্রহ করতে। দোতলা এই পুস্তকাগারে শিশু বিভাগ, পাঠ্যপুস্তক, কর্মজীবন নির্দেশিকা (কেরিয়ার গাইডেন্স), গবেষণা বিভাগ আছে। রয়েছে আলোচনা কক্ষ। এখানে আসা বিখ্যাত মানুষদের ব্যবহার করা চেয়ার-টেবিল প্রভৃতিও যত্ন করে রাখা আছে একটি ঘরে।
এ হেন পুস্তকাগারের কর্মী বলতে রয়েছেন শুধু গ্রন্থাগারিকই। জেলার দুই প্রান্তে আরও তিনটি গ্রন্থাগারের দায়িত্ব সামলে তিনি এখানে আসতে পারেন সোম এবং বুধবার। আর কোনও কর্মী নেই। তবে, গ্রন্থাগার চলে নিয়ম মেনে। সৌজন্যে— স্থানীয় বইপ্রেমীর দল। দুই স্বেচ্ছাসেবক নামমাত্র টিফিন-খরচ নিয়ে পরিষেবা দেন। ফেসবুকে বুঁদ হয়ে যাওয়া সময়ে এই গ্রন্থাগারে দৈনিক গড়ে ৭০-৮০ জন আসেন বলে কর্তৃপক্ষ জানান। করোনা-পর্বে যখন সব বন্ধ, এখানকার ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার মানুষের বাড়িতে বই পৌঁছে দিয়ে নজির গড়েছে। পর্যাপ্ত কর্মী নিয়োগের দাবি রয়েছে এলাকাবাসীর।
পুস্তকাগারের স্বেচ্ছাসেবক, পাঠক-পাঠিকাদের পাশাপাশি ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, চিকিৎসক, কবি, সাহিত্যিক, চাকরিজীবী শিক্ষাবিদ, গৃহবধূ— সবাই ছিলেন সাম্প্রতিক পদযাত্রায়। ছিলেন মেয়র রাম চক্রবর্তীও।
মেয়র বলেন, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতেও চন্দননগর শহর বই ও গ্ৰন্থাগার কতটা ভালবাসে, পদযাত্রা তা প্রমাণ করছে।’’ গ্রন্থাগারিকের উচ্ছ্বাস, ‘‘পদযাত্রায় এসে অনেকেই পুস্তকাগারের সদস্য হতে চেয়েছেন।’’