মলিন: শরৎচন্দ্রের গুরুগৃহ। —নিজস্ব চিত্র।
পাশের জেলা হাওড়ার সামতাবেড়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু, হুগলির দেবানন্দপুরে কথাশিল্পীর জন্মভিটে সেই তিমিরেই! তাঁর আরও এক জন্মদিন পেরিয়ে গেল এই আক্ষেপ নিয়েই।
লেখককে নিয়ে চর্চাকারীরা জানান, শরৎচন্দ্রের শৈশবের পাঠ শুরু মোহন মুন্সির দালানে। তার পরে প্যারী পণ্ডিতের (প্যারীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়) পাঠশালা। মোহন মুন্সির দালান অস্তিত্ব হারিয়েছে। প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালাও সে পথে!
কী অবস্থা সেটির?
রাস্তার পাশে জীর্ণ দেওয়াল, ভাঙা দরজা। বোর্ডের লেখা জানান দেয়— সেটিই কথাশিল্পীর গুরুগৃহ। সামনের ছাদ-ভাঙা একটি ঘরের কঙ্কাল শুধু অবশিষ্ট। চতুর্দিকে ঝোপ-জঙ্গল। সাপখোপের আস্তানা। লতাপাতায় চোখ আটকায়।
শরৎ-অনুরাগীরা চান, ওই ভবনের হাল ফিরিয়ে আগলে রাখা হোক। আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালা বসত প্রশস্ত চণ্ডীমণ্ডপে। পণ্ডিতমশাই শরৎচন্দ্রকে বিশেষ স্নেহ করতেন। দুরন্ত প্রকৃতির শরতের সঙ্গে পণ্ডিতমশাইয়ের ছেলে কাশীনাথের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। বন্ধু পরবর্তী সময়ে শরতের গল্পের ‘কাশীনাথ’ হয়ে ওঠেন।
পাঠশালায় এক ছাত্রীর সঙ্গে শরতের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। ডোঙায় চেপে সরস্বতী নদীতে বেড়ানো, মাছ ধরা, বৈঁচিফুলের মালা গাঁথা, বাগানে ফল চুরি, ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ায় ছোট্ট শরতের সঙ্গী ছিল সে। অনেকে মনে করেন, সে-ই ‘দেবদাস’ উপন্যাসে পার্বতী, ‘শ্রীকান্ত’-র রাজলক্ষীর ছোটবেলা হয়ে ফিরেছে। প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালার স্মৃতি রয়েছে ‘দেবদাস’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘কাশীনাথ’ রচনায়। কথাশিল্পীর জীবন ও সাহিত্য জুড়ে যে পাঠশালার বিস্তার, তার বাস্তব চেহারা আজ মলিন। স্থানীয়দের একাংশের বক্তব্য, বাড়িটি ব্যক্তি-মালিকানায় থাকায় সংস্কার করা যায়নি। চেষ্টা করেও কোনও উত্তরাধিকারীর খোঁজ মেলেনি। শরৎচন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারের প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক শ্যামল সিংহের মন্তব্য, ‘‘পাঠশালাটি অস্তিত্ব হারালে জন্মস্থানে শরৎচন্দ্রকে দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই, সংরক্ষণ জরুরি।’’
শরৎচন্দ্রের জন্মভিটেকে কেন্দ্র করে পর্যটনকেন্দ্র তৈরির দাবি পুরনো। এক বছর পরেই লেখকের জন্ম সার্ধ-শতবর্ষ। তার আগে ওই দাবি ফের জোরালো হচ্ছে। শরৎচন্দ্রের নামে তোরণ, শিশুউদ্যান, নদীর পাড় সংস্কার, অতিথিশালা তৈরি প্রভৃতি দাবি রয়েছে। শরৎ-ভিটেতে আজও আলো নেই। দিন ফুরোলে আঁধার ঘনায় পল্লিসমাজের লেখকের আঁতুড়ঘরে। পাঠাগার কার্যত কর্মীশূন্য। গ্রন্থাগারিক বাদে স্থায়ী কর্মী নেই। গ্রন্থাগারিক জেলার আরও দুই গ্রন্থাগারের দায়িত্বে। দেবানন্দপুরে তাঁর বরাদ্দ সপ্তাহে এক দিন। অন্য দিন পর্যটক এলে প্রদর্শশালার বন্ধ গেট দেখে ফিরতে হয়। নেই কেয়ারটেকার।
মহকুমাশাসক (সদর) সৈকত গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আগে কোনও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল কি না, হলে কোথায় দেওয়া হয়েছিল, কোথায় আটকে আছে, খোঁজ নিয়ে দেখব। সেই মতো পদক্ষেপ করা হবে।’’
দেবানন্দপুরের বাসিন্দা, শরৎ অনুরাগী মধুসূদন চক্রবর্তীর খেদ, ‘‘বিভিন্ন দফতরে আবেদনপত্র পাঠানো হয়েছিল। নানা পরিকল্পনা হয়েছিল। শুধু রাস্তা হয়েছে, তিন জায়গায় আলো বসেছে। আর কিছু হয়নি। খারাপ লাগে।’’ ষাটোর্ধ্ব মানুষটির সংযোজন, ‘‘শরৎচন্দ্রকে মনে রেখে জায়গাটি সুন্দর করে সাজানো হোক।।’’
জন্ম সার্ধ-শতবর্ষের আগে কথাশিল্পীর জন্মভিটেকে আলোয় আনতে কি উদ্যোগী হবেন তাবড় জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা!