গঙ্গার ভাঙনের জেরে ভদ্রেশ্বরের কয়লাডিপো ঘাটের পাশে প্রায় ১০০ ফুট এলাকা যে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে ওই এলাকার অনেকেই উদ্বেগে রয়েছেন বলে সংবাদপত্রে পড়লাম। ধসের পাশেই পণ্যবাহী ট্রেনের লাইন। সেই রেললাইনও তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। অনেকে হয়তো খেয়াল করেননি, ওই ধসে একটি ঐতিহাসিক নির্মাণও ভেঙে তলিয়ে গিয়েছে।
ভদ্রেশ্বর একসময়ে ছিল পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় গঞ্জ বা বাণিজ্যকেন্দ্র। কালনা থেকে কলকাতার মধ্যে এতবড় গঞ্জ কোথাও ছিল না। এখান থেকে প্রায় মাইল পঞ্চাশেক ব্যাসার্ধের মধ্যে গোটা অঞ্চলের চাল, ডাল, খাদ্যশস্য, লবণ, পাট রেশম ইত্যাদি সরবরাহ হত। বর্তমানে গঙ্গার অবস্থান ভদ্রেশ্বরের পূর্ব দিকে। আগে গঙ্গা কিছুটা উত্তরে বাঁক নিয়ে ভদ্রেশ্বর গঞ্জেও ঢুকে ছিল। বড় বড় নৌকা ওই বাঁকে এসে দাঁড়াত। মাল ওঠানো-নামানো হত।
ভদ্রেশ্বরের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল বেশ সুবিধাজনক। নদীর ধারে ছিল ঘাট ও গুদামঘর। ১৮৭৬-এ প্রকাশিত ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের লেখা ‘আ স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল’ বইয়ের তৃতীয় খণ্ডে ভদ্রেশ্বর থেকে বাণিজ্যের বাড়বাড়ন্তের কথা রয়েছে।
সপ্তগ্রাম বন্দরের অবনতির পরে দক্ষিণে গঙ্গার পাড়ে হুগলি বন্দর-শহর হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৫৪০-এর পরে হুগলিতে কুঠি গড়ে ব্যবসা করতে শুরু করে পর্তুগিজ বণিকেরা। এর পরে ক্রমে গঙ্গার তীরে চুঁচুড়া, চন্দননগর, ভদ্রেশ্বর, শ্রীরামপুরে কুঠি গড়ে ব্যবসা করতে নেমে পড়ে যথাক্রমে ওলন্দাজ, ফরাসি, জার্মান ও দিনেমার বণিকের দল। চন্দননগরে যেমন ফরাসি বণিকেরা আসে, ভদ্রেশ্বরে ঘাঁটি গেড়ে ব্যবসা করতে শুরু করে বেলজিয়ান বা ফ্লেমিশ বণিকেরা। সালটা মোটামুটি ১৭২০ থেকে ১৭২৫-এর মধ্যবর্তী সময়ে। কয়েক বছর পরে তারা চলে যায় নদীর ও পাড়ে, উত্তর ২৪ পরগনার বাঁকিবাজারে। ফ্লেমিশরা চলে যাওয়ার পরে ভদ্রেশ্বর অঞ্চলটি ব্রিটিশদের দখলে আসে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রেলপথ চালু করার পরিকল্পনা করেছিল প্রধানত দু’টি কারণে। এক, সামরিক প্রয়োজনে অতি দ্রুত সৈন্য পাঠাতে এবং দুই, এ দেশ থেকে কাঁচামাল ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাঠাতে। যাত্রী পরিবহণ ছিল গৌণ। ফলে, ১৮৫৪ সালের ১৫ অগস্ট হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত পূর্ব রেলের প্রথম ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার মাস ছয়েকের মধ্যেই একটি মালগাড়ির ‘সাইডিং লাইন’ তৈরি হয়ে যায়। ভদ্রেশ্বর স্টেশন তৈরির অনেক আগেই নদীর তীরে, গঞ্জের কাছেই তৈরি হয়ে যায় ভদ্রেশ্বর ঘাট মাল-গুদাম স্টেশনটি। ওই স্টেশনটির পাশেই ছিল সিমেন্ট বাঁধানো জেটি। নদীর পাড়ের সেই জেটিটিইভেঙে পড়েছে।
রেললাইন আসার পর থেকেই জেটি থেকে নৌকা চলাচল ক্রমশ কমতে থাকে। একসময়ে বন্ধই হয়ে যায়। শুধু ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে ছিল পাকা জেটিটি। অবহেলায় পড়ে থাকা সিমেন্টের জেটির আনাচে-কানাচে গাছের চারা গজিয়ে উঠতে থাকে। জেটি কমজোরি হতে থাকে। বছর দু’তিনেক আগে পর্যন্ত জেটির কাছে বাঁধা থাকত একটি বয়া। সেটিকে খুলে নিয়ে চলে যানবন্দর কর্তৃপক্ষ।