দেওয়ালে এমনই ছবিতে সেজে উঠেছে বাঁকুড়ায় আদিবাসীদের বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।
গাছ, লতাপাতা, বিভিন্ন পশুপাখি এবং শিকারের ছবি দিয়ে বাড়ি-ঘরের দেওয়াল সাজানোই আদিবাসীদের মধ্যে দস্তুর। কিন্তু সম্প্রতি সেই দেওয়ালচিত্রেও দেখা যাচ্ছে বদলের ছাপ। বিচ্ছিন্ন ভাবে হলেও বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় আধুনিক ফেসবুক, এক্স, হোয়াট্সঅ্যাপ এবং ইউটিউবের আইকনে সাজছে আদিবাসীদের বাড়ির দেওয়াল। আর তা দেখে শিল্পী থেকে শুরু করে কলারসিকরা প্রমাদ গুনছেন। নিজস্ব শিল্পসত্তা হারানোর আশঙ্কা করছে আদিবাসীদের একাধিক সামাজিক সংগঠন।
বাঁধনা, সহরাই-সহ বিভিন্ন উৎসবের আগে নিজেদের গ্রামকে সাজিয়ে তোলার রীতি রয়েছে আদিবাসীদের মধ্যে। প্রতিটি উৎসবের আগে মাটির ঘরের দেওয়াল চিত্রকলায় সাজিয়ে তোলেন আদিবাসী পরিবারের মহিলারা। তাঁদের আঙুলের ছোঁয়ায় ঘরের দেওয়ালগুলি হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়। এত দিন মূলত লতাপাতা, বিভিন্ন জীবজন্তু, পশুপাখি এবং উৎসবের খণ্ডচিত্র আঁকা হত। কিন্তু আদিবাসীদের সেই নিজস্ব অঙ্কনরীতিতেও লেগেছে ‘বিশ্বায়নের ছোঁয়া’। লতাপাতা, জীবজন্তু, পশুপাখির ছবি ছেড়ে তাঁদের বাড়ির দেওয়ালে এখন স্থান পাচ্ছে ফেসবুক, হোয়াট্সঅ্যাপ, এক্স, ইউটিউব আইকনের ছবি। কোথাও আবার আদিবাসীদের দেওয়াল সেজেছে আধুনিক ট্রেনের ছবিতে। সম্প্রতি বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড় লাগোয়া আদিবাসী প্রধান শিউলিবনা গ্রামে স্থানীয় একটি উৎসব উপলক্ষে লালগড় কলেজের ছাত্রী সুজাতা কিস্কু নিজের বাড়ির দেওয়াল সাজিয়েছেন এমনই সব ছবি দিয়ে। এর মধ্যে তেমন দোষের কিছুও দেখছেন না ওই কলেজছাত্রী। ওই কলেজছাত্রীর কথায়, ‘‘আমি সব রকমের দেওয়ালচিত্রই আঁকতে পারি। কিন্তু এ বার পরিস্থিতি ছিল আলাদা। কলেজ থেকে ছুটি পাওয়ার পর বাড়িতে ফিরে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই গ্রামে উৎসব শুরু হয়। লতাপাতা, জীবজন্তু বা পশুপাখির ছবি আঁকা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। তা আঁকার মতো সময় হাতে ছিল না। অগত্যা তড়িঘড়ি ফোনে দেখা আইকনগুলি এঁকে আমাদের বাড়ির দেওয়াল সাজিয়েছি।’’
বাঁকুড়ার বিভিন্ন আদিবাসী গ্রামেই এমন বদলে যাওয়া ছবি দেখে আঁতকে উঠছে শিল্পীমহল। তাঁরা বলছেন, ‘‘বদলাতে বদলাতে একদিন নিজস্ব দেওয়ালচিত্রের অঙ্কনরীতি হারাবে আদিবাসী সমাজ।’’ প্রমাদ গুনছেন আদিবাসীদের একাধিক সামাজিক সংগঠনও। বাঁকুড়া জেলা স্কুলের অঙ্কনশিক্ষক মহাদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আদিবাসীদের দেওয়ালচিত্রের একটি বিশেষ ঘরানা রয়েছে। তার বিষয়বস্তুও সম্পূর্ণ পৃথক। কিন্তু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জেরে আদিবাসীরাও তাঁদের দেওয়ালচিত্রের স্বতন্ত্রতা হারিয়ে ফেলছেন। এই বদল সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।’’ আদিবাসীদের সামাজিক সংগঠন ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের বাঁকুড়া জেলা গোডেৎ (সভাপতি) বিপ্লব সোরেনের বক্তব্য তেমনই। তিনি বলেন, ‘‘সংস্কৃতির কোনও সীমানা হয় না। অন্যের সংস্কৃতি আপন করার মধ্যে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির স্বতন্ত্রতা বাঁচিয়ে রেখে তার পর অন্যের সংস্কৃতি গ্রহণ করা উচিত। এ ভাবে দেওয়ালচিত্রের ধরন বদলে গেলে আদিবাসীদের আগামী প্রজন্ম বদলে যাওয়া ধরনকেই নিজেদের বলে গ্রহণ করবে। এতে অস্তিত্ব হারাবে আদিবাসীদের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি।’’