চাকরিপ্রার্থীদের কান্না। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
কলকাতা হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে বৃহস্পতিবার ২০১৬ সালের এসএসসিতে নিয়োগের পুরো প্যানেল বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট। বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ জানিয়েছে, পুরো প্রক্রিয়ায় কারচুপি করা হয়েছে। ওই নিয়োগপ্রক্রিয়ার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। সেই সঙ্গে প্রায় ২৬ হাজার জনের চাকরি (আদতে ২৫,৭৩৫) বাতিল করে জানানো হয়েছে, নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। যাঁরা অন্য সরকারি চাকরি ছেড়ে ২০১৬ সালের এসএসসির মাধ্যমে স্কুলের চাকরিতে যোগদান করেছিলেন, তাঁরা চাইলে পুরনো কর্মস্থলেও ফিরে যেতে পারবেন বলে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। মানবিক কারণে শুধুমাত্র ক্যানসার আক্রান্ত প্রার্থী সোমা দাসের চাকরি বহাল রাখা হয়েছে।
কী ভাবে শুরু?
২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এসএসসি-তে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই বছরই ২৭ নভেম্বর ওএমআর শিটে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর দু’বছর পর ২০১৮ সালের ১২ মার্চ প্রকাশ করা হয় চূড়ান্ত প্যানেল। ২৮ অগস্ট প্রকাশিত হয় প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের মেধাতালিকা। ২০১৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষক হিসাবে চাকরি পান নির্বাচিতেরা।
২০১৬ সালের সেই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০২১ সালে। কলকাতা হাই কোর্টে দায়ের হয় একগুচ্ছ মামলা। অভিযোগ ওঠে, গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মী, নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগে যথেচ্ছ দুর্নীতি হয়েছে। ২০২১ সালে ওই সংক্রান্ত একটি মামলায় প্রথম সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তার পরের দু’বছরে নিয়োগ দুর্নীতির প্রায় ১০টি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। সিবিআইয়ের তদন্তের পাশাপাশি ‘বেআইনি নিয়োগ’ বাতিল করারও নির্দেশ দেন প্রাক্তন বিচারপতি।
সুপ্রিম রায়ে ফের হাই কোর্টে ফেরত
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের সিঙ্গল বেঞ্চের কিছু রায় স্থগিত করে দেয় হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি হরিশ টন্ডনের ডিভিশন বেঞ্চ। পরে আবার সিঙ্গল বেঞ্চের বেশ কিছু রায় বহাল রাখে হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি সুব্রত তালুকদারের ডিভিশন বেঞ্চ। ওই সব নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে বিক্ষিপ্ত ভাবে একাধিক মামলা দায়ের হয়। শেষমেশ ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর শীর্ষ আদালতের বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু এবং বিচারপতি বেলা এম ত্রিবেদীর বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি একটি বিশেষ বেঞ্চ গঠন করবেন। সেখানেই এসএসসির নিয়োগ দুর্নীতির যাবতীয় মামলার শুনানি হবে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির বিশেষ বেঞ্চে এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলার শুনানি শুরু হয় কলকাতা হাই কোর্টে। জানুয়ারি থেকে মার্চ, এই তিন মাসে মোট ১৭টি শুনানি হয় বিশেষ বেঞ্চে। শেষমেশ ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল ২৮২ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা করে হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।
কী রায় দিয়েছিল হাই কোর্ট?
২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ রায় দেয়, ২০১৬ সালের ওই নিয়োগপ্রক্রিয়া সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ এবং ১৬-র লঙ্ঘনকারী। তাই পুরো নিয়োগপ্রক্রিয়াই বাতিল করা হবে। অর্থাৎ, চাকরি যাবে ২৫,৭৫৩ জনের। পাশাপাশি, জনসাধারণের দেখার জন্য সমস্ত ওএমআর শিট স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে। প্যানেল-বহির্ভূত ভাবে, সাদা খাতা জমা দিয়ে কিংবা মেয়াদ-উত্তীর্ণ প্যানেলে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, চার সপ্তাহের মধ্যে তাঁদের বেতন ১২ শতাংশ সুদ-সমেত ফেরত দিতে হবে, কারণ ওই টাকা সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া হয়েছে। তা জনগণের টাকা। সেই সঙ্গে ওই মামলায় সিবিআইকে আরও তদন্ত করে তিন মাসের মধ্যে নিম্ন আদালতে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
ফের সুপ্রিম কোর্টে
২০২৪ সালের ২৪ এপ্রিল, হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চের রায় ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য। ২৯ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চে মামলাটি শুনানির জন্য ওঠে। পৃথক ভাবে শীর্ষ আদালতে মামলা করে রাজ্যের শিক্ষা দফতর, এসএসসি এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। দফায় দফায় মামলা করেন চাকরিহারারাও।
২০২৪ সালের ৭ মে হাই কোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানায়, এই মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর বেআইনি ভাবে নিযুক্ত ব্যক্তিদের পুরো বেতন ফেরত দিতে হবে। পাশপাশি, সিবিআই-কে হাই কোর্টের নির্দেশ মেনে বেআইনি ভাবে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করার ছাড়পত্র দেয় সু্প্রিম কোর্ট।
এর পর ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট জানায়, ওই মামলায় প্রধান পাঁচটি পক্ষ— পশ্চিমবঙ্গ সরকার, এসএসসি এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, হাই কোর্টের মূল মামলাকারীরা, হাই কোর্টের নির্দেশে যাঁদের চাকরি বাতিল হয়েছে এবং সিবিআই-এর বক্তব্য শুনবে আদালত।
সুপ্রিম কোর্টে এই মামলাটি মোট ২০ বার শুনানির জন্য ওঠে। বিভিন্ন পক্ষের প্রায় ৪০০ আইনজীবী মামলায় যোগ দেন। শেষমেশ ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানি শেষ হয় প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চে। রায় ঘোষণা স্থগিত রাখে আদালত। বৃহস্পতিবার ওই মামলাতেই রায় ঘোষণা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার জনের নিয়োগ।
ভ্রম সংশোধন: এই খবরটি প্রথম প্রকাশের সময়ে লেখা হয়েছিল, তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বলেছে আদালত। কিন্তু এই তিন মাসের সময়সীমা সমগ্র নিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আদালতের রায়ের প্রতিলিপিতে লেখা হয়েছে, চাকরিহারা যে প্রার্থীরা আগে কোনও সরকারি দফতরে বা সরকার পোষিত দফতরে চাকরি করতেন, তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরকে তাঁদের চাকরি ফেরত দিতে হবে। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।