বর্ধমান মেডিক্যালে ক্যানসার আক্রান্ত। নিজস্ব চিত্র
তিন বার বাঁকুড়া থেকে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি। চিকিৎসার জন্য। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত ওই প্রৌঢ়কে তিন বারই চিকিৎসা না-পেয়ে ফিরতে হয়েছিল। প্রথম দিন সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ছিলেন না। দ্বিতীয় বার ডাক্তার থাকলেও শয্যা ছিল না। তৃতীয় বার শয্যা থাকলেও তাঁর সঙ্গে পরিবারের কেউ না-থাকায় হাসপাতাল তাঁকে ভর্তি করতে রাজি হয়নি। আর ফিরে আসেননি তিনি। কার্যত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছিল তাঁর।
প্রৌঢ়ের ঘনিষ্ঠেরা জানাচ্ছেন, মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘‘ক্যানসার রোগীদের জন্য কেন গ্রিন করিডরের মতো কিছু ভাবে না সরকার? হয় সেই করিডর ধরে হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে, নয়তো সোজা স্বর্গে পৌঁছে যাব!’’ কথাগুলোর মধ্যে শ্লেষ ছিল। কিন্তু ইদানীং অনেকেই বলছেন, অঙ্গদানে সাফল্য আনতে গ্রিন করিডরের ব্যবস্থা করা হয়েছে এ রাজ্যেও। ট্র্যাফিকের ঝক্কি এড়িয়ে জেলা থেকে শহরে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছনোর জন্যই এই ব্যবস্থা। ক্যানসারের ক্ষেত্রে তেমন কোনও গ্রিন করিডর চালু করা যায় না, যেখানে এক জন রোগী আনুষঙ্গিক সমস্যা এড়িয়ে যথাযথ চিকিৎসার সুযোগ পাবেন?
অর্থনীতির শিক্ষক অরিজিতা দত্তের প্রস্তাব, যে-ভাবে জননী সুরক্ষা যোজনায় কোনও প্রসূতি হাসপাতালে এলে তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গীকে গাড়িভাড়া বাবদ অর্থ দেওয়া হয়, সেই ভাবেই ক্যানসার রোগীদের জন্য ভাতা চালু করা যেতে পারে। এতে কমানো যেতে পারে ‘ড্রপ আউট’। আর রোগী হয়রানি এবং দিনের পর দিন হাসপাতালে এসে ডেট না-পাওয়ার ভোগান্তি ঠেকাতে পরীক্ষা বা ভর্তি অনলাইনে করার ব্যবস্থা জরুরি। কোনও নিরক্ষর মানুষের পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়। সে-ক্ষেত্রে জেলা হাসপাতালকে বুকিংয়ের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় জোর দিয়েছেন দ্রুত চিকিৎসা শুরুর উপরে। তিনি বলেন, ‘‘রোগ নির্ণয়ের চার সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসা শুরু হওয়া খুব জরুরি। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই সেই সময় সরকারি পরিসরে মানা সম্ভব হয় না। তখন সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও রোগীরা বেসরকারি স্তরে আসেন। জেলা স্তরের হাসপাতাল এবং এই যে এত সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হয়েছে, সেখানে ক্যানসার বিভাগটাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সবাইকে শহরে ছুটে আসতে হবে কেন?’’
বাস্তব হল, ক্যানসার রোগীকে যে সব সময়ে কেমোথেরাপি বা রেডিয়োথেরাপির জন্যই শহরে আসতে হয়, তা নয়। ক্যানসার রোগীর অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা হলেও বহু ক্ষেত্রে স্থানীয় হাসপাতাল দায় এড়ায়। ‘রেফারাল’ ব্যবস্থা যুক্তিসঙ্গত না-হওয়া পর্যন্ত এ থেকে মুক্তি নেই। অথচ ‘রেফার’ ঠেকাতে স্বাস্থ্য দফতরের হাজারো ঘোষণার পরেও বিশেষ লাভ হয়নি। স্বাস্থ্যকর্তাদের বড় অংশ স্বীকার করে নেন, এর পিছনে পরিকল্পনাগত ফাঁক রয়েছে। আর রয়েছে নির্দেশ জারির পরে নিচু তলায় তা মানার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা।
পরিকল্পনাগত ত্রুটির উদাহরণ দিতে গিয়ে চিকিৎসকদের বড় অংশ জানিয়েছেন, অর্থের অভাব না-থাকলেও ঠিক কোন খাতে কী ভাবে টাকা খরচ হবে, সে নিয়ে কারও স্পষ্ট ধারণা নেই। ক্যানসার খাতে রাজ্যের বরাদ্দ কত? রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ক্যানসার খাত বলে আলাদা কিছু নেই। স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দের একটা অংশ ক্যানসারের জন্য খরচ হয়। কিন্তু সেটা কত শতাংশ, তা ঠিক করা নেই। তিনি বলেন, ‘‘আমরা মোট টাকা বরাদ্দ করে দিই। তার থেকে কত টাকায় কারা কী ওষুধ কিনছে, সেটা নির্দিষ্ট কিছু থাকে না। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল রাজ্যের নোডাল সেন্টার। ওদের টাকা দেওয়া হয়। ওরা ওষুধ কিনে জেলাগুলিকে দেয়। এ ছাড়া, জেলায় স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ টাকা থেকে সংশ্লিষ্ট জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা ওষুধ কেনেন।’’
কিন্তু নোডাল সেন্টারের বিরুদ্ধেই তো রোগী ফেরানো থেকে শুরু করে ওষুধের সরবরাহ না-থাকা, মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে রোগী চলে যাওয়ার অজস্র অভিযোগ। যদিও এনআরএসের ক্যানসার বিভাগের প্রধান শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডলের দাবি, ‘‘আমাদের হাসপাতাল থেকে ড্রপ আউট তেমন হয়ই না। ক্যানসার চিকিৎসায় কাউন্সেলিং সবচেয়ে জরুরি। সে দিকে খেয়াল রাখি। তাই রোগীরা চিকিৎসা বন্ধ করেন না।’’ কিন্তু যে সময়ে চিকিৎসা শুরু হওয়া দরকার, তখন কি শুরু করা যায়? তিনি বলেন, ‘‘সব ক্ষেত্রে যায় না।’’ সেই রোগীরা কি সবাই অপেক্ষা করেন বা ফেরত আসেন? উত্তর মেলেনি।
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের ক্যানসার বিভাগের প্রধান প্রবীর মাইতি মনে করেন, ড্রপ আউটের কারণ রোগী ভেদে আলাদা হয়। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কাছে তো রোগীদের ফোন নম্বর থাকে। যদি কেউ নির্দিষ্ট সময়ে ফলো আপে না-আসেন, তা হলে যোগাযোগ করে কারণটা জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিপুল রোগীর চাপ সামলে ডাক্তারদের পক্ষে সেটা অসম্ভব। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে এই দায়িত্ব দেওয়া হলে অসংখ্য রোগী উপকৃত হবেন।’’
কিন্তু যে কাজ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, সেই কাজে অন্যের সাহায্য নিয়ে গরিব রোগীদের পাশে দাঁড়াতে কতটা উৎসাহী স্বাস্থ্য দফতর? ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের মূল স্রোতে ফেরাতে একটি কেন্দ্র খুলতে উদ্যোগী হয়েছেন সমাজকর্মী পার্থ সরকার। তিনি বলেন, ‘‘প্রতি বছর ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের ৪০ শতাংশের মৃত্যু হয় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে রিহ্যাব সেন্টার নাথাকায়। রিহ্যাব সেন্টার গড়তে চেয়ে সরকারের কাছে বার বার সাহায্যের আবেদন করেছি। ফল হয়নি।’’
অর্থ, সদিচ্ছা, লোকবল— সবই আছে। শুধু নেই সেগুলোকে এক সুতোয় বেঁধে যথাযথ ফল পাওয়ার মতো পরিকল্পনা। সমাজকর্মী অনুপ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এক জন ক্যানসার রোগী শেষ পর্যন্ত বা প্রথম থেকে চিকিৎসা না-করলে তার নিজের এবং পারিবারিক ক্ষতি। কিন্তু সেই মানুষ যদি অসহ্য কষ্ট নিয়ে মারা যান, তাতে অনেক বেশি সামাজিক ক্ষতি। ভুল বার্তা যায় সমাজের কাছে।’’
কর্তারা শুনছেন?