ছুটি যেন ফুরোতেই চাইছে না সরকারি অফিসে!
মাসখানেকের মধ্যে খোলা মাত্র ১১ দিন! কর্মসংস্কৃতির এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গোটা দেশে নজির তৈরি করেছে মমতার সরকার।
সরকারি কর্মী মানেই ‘আসি যাই মাইনে পাই’ — বাম আমলে লালিত এই ধারণা পাল্টে দেবেন বলে ২০১১-য় ক্ষমতায় এসেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। পরিস্থিতি পাল্টানো দূরে থাক, এই আমলে কর্মচারীদের ছুটির সংখ্যা বাড়িয়ে নবান্নের কর্তারা কর্মসংস্কৃতির দফারফা করে দিয়েছেন বলেই অনেকের মত। তাঁদের কটাক্ষ, ‘‘এই সরকার ছুটির দেশেই রয়েছে।’’
অথচ সরকার গঠনের পর বলা হয়েছিল, প্রশাসনের কাছে বিভিন্ন প্রয়োজনে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা সাধারণ মানুষ যাতে সুবিচার পান, তা নিশ্চিত করবে পরিবর্তনের সরকার। নবান্ন থেকে ব্লক অফিস পর্যন্ত প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে কর্তাদের হুঁশিয়ারি থেকে নিত্য-নতুন নিয়ম চালু করার নজিরও কম দেখা যায়নি। সরকার যে ‘কাজ-অন্ত-প্রাণ’ তা বোঝাতে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ডাকা বন্ধের দিন অফিস চালু রাখতে আগের রাত থেকে অফিসেই কর্মীদের রাখার বন্দোবস্ত করেছেন প্রশাসনের কর্তারা। এমনকী, বন্ধের দিন কামাই হলে এক দিনের ছুটি কাটার হুমকি দিয়ে বিজ্ঞপ্তিও জারি করেছে নবান্ন। এত কিছুর পরেও সরকারি অফিসে কাজের পরিবেশ ফেরেনি। উল্টে কর্মীদের জন্য বাড়তি ছুটির ব্যবস্থা করে সরকার নিজেই যেন গয়ংগচ্ছ ভাবকে প্রশ্রয় দিয়েছে।
মমতা সরকারের বদান্যতায় কত ছুটি পান সরকারি কর্মীরা?
নবান্নের দেওয়া তথ্য বলছে, অক্টোবরে দুর্গাপুজো উপলক্ষে টানা ১২ দিন সরকারি অফিস বন্ধ রাখার বন্দোবস্ত করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুজো ছিল। আবার, কালীপুজো উপলক্ষে এখন পরম নিশ্চিন্তে ছুটি কাটাচ্ছেন আমলা-কর্মী সকলেই। মঙ্গলবার কালীপুজো, বুধবার দেওয়ালির ছুটি। বৃহস্পতি ও শুক্রবার ভাইফোঁটা উপলক্ষে সরকারি অফিসের দরজা বন্ধ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শনি ও রবিবারের সপ্তাহান্তিক ছুটি। সব মিলিয়ে টানা ছ’দিন! রাজ্য সরকারের কালেন্ডার বলছে, গত ১৭ অক্টোবর থেকে আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে অফিস খোলা থাকছে মাত্র ১১ দিন। নবান্নের খবর, অনেক কর্মী সোমবার একটি ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে আরও লম্বা ছুটির ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। তাঁরা গত সপ্তাহের শনি ও রবিবার ধরে টানা ন’দিন ছুটি উপভোগ করছেন। ছুটি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর এমন দরাজহস্ত দেখে নবান্নের চালু রসিকতা হল, পরের বার ক্ষমতায় এলে গ্রীষ্ম ও শীতের ছুটিও চালু হতে পারে রাজ্য সরকারি অফিসে।
টানা ছুটির মতো কর্মীদের দৈনন্দিন কাজের জগতেও ছুটি ছুটি ভাব। সেই বাম আমলের মতোই দেরিতে এসে আগে অফিস ছাড়ার ট্রাডিশন অব্যাহত। অনেকের মতে, প্রশাসনের সদর দফতর মহাকরণ থেকে নবান্নে স্থানান্তরিত হতেই কর্মীদের উপর কর্তাদের নিয়ন্ত্রণ অনেক আলগা হয়ে গিয়েছে। মহাকরণে এখনও যে ক’টি দফতর রয়েছে, তার কর্মীরা কখন অফিসে আসেন, কখন চলে যান— হিসাব কেউ রাখে না। আর নবান্নের কর্মীদের কাজকর্ম নিয়ে প্রশাসনের একাংশের প্রতিক্রিয়া, সংবাদমাধ্যমের গতিবিধির উপরে নজর রাখতে সরকার যতটা তৎপর, কর্মীদের ক্ষেত্রে ততটাই অগোছালো।
কর্মসংস্কৃতির এমন অবস্থার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। যথারীতি বিভিন্ন মহলের অভিযোগ, এমনিতেই সরকারি পরিষেবা পেতে সাধারণ মানুষের কালঘাম ছোটে। এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ফাইল যেতে মাস গড়িয়ে যায়। এই যখন অবস্থা, তখন টানা ছুটির জেরে পরিষেবা মাথায় উঠেছে। একাধিক দফতরের কর্তাদের অভিযোগ, অফিস টানা বন্ধ থাকায় অনেক প্রকল্পের অর্থ পেতে সময় লেগে যাচ্ছে। পিছিয়ে যাচ্ছে বহু কাজ। অনেকের মতে, টানা তিন-চার দিন ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকলে দেশ তোলপাড় হয়ে যায়। আর এই সরকারে টানা ১০-১২ দিন ছুটি চললেও নবান্ন যেন নির্বিকার!
বিরোধী কর্মী-ইউনিয়নগুলি অবশ্য মনে করে, ছুটি এবং কাজকর্ম নিয়ে এই সরকারের কিছু বলার থাকতে পারে না। কারণ, এই সরকার কর্মীদের মহার্ঘভাতা বাকি রেখেছে প্রায় ৫০%। তাই ছুটি বাড়িয়ে কর্মীদের খুশি রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।
রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতা মনোজ গুহর প্রতিক্রিয়া, ‘‘এই সরকার মেলা-খেলা-মোচ্ছবের সরকার। এদের থেকে এর বেশি কিছু আশা করেন না সরকারি কর্মীরা।’’ আইএনটিইউসি অনুমোদিত সরকারি কর্মী সংগঠন কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজের নেতা মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কর্মীদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে, তার বদলে ছুটি দিয়ে মন জয় করতে চাইছে সরকার। এই ফন্দি কর্মীরা বুঝে গিয়েছেন।’’ বিজেপি প্রভাবিত সংগঠন সরকারি কর্মচারী পরিষদের সম্পাদক সঙ্কেত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ছুটি নয়, রুটি চাই। সরকার সেটা বুঝলেই মঙ্গল।’’ তবে তৃণমূল প্রভাবিত সরকারি কর্মী সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের আহ্বায়ক সৌম্য বিশ্বাসই মনে করেন, ‘‘রাজ্যের মানুষের উৎসবকে সরকার স্বীকৃতি দেয়। এতে অসুবিধের কিছু নেই।’’