বাংলাদেশের চলমান ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে হিন্দুত্বের আবেগই বাংলায় এগোনোর তাস বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব। —ফাইল চিত্র।
লোকসভা নির্বাচন থেকে যে ধাক্কা খাওয়া শুরু হয়েছে, সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে বিধানসভা উপনির্বাচনেও। তারই মধ্যে আর জি কর-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের গতি-প্রকৃতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে অস্বস্তি। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের চলমান ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে হিন্দুত্বের আবেগই বাংলায় এগোনোর তাস বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব। তবে একই সঙ্গে তাঁদের বিবেচনায় আছে, তার পরেও বঙ্গের লড়াই কঠিনই থাকবে!
আগের বারের চেয়ে আসন কমে গেলেও রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে ৩৮% ভোট পেয়েছিল বিজেপি। তার পর থেকেই হিন্দুত্বের চড়া সুর তুলে সরব হয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর অঙ্ক, হিন্দু ভাবাবেগে ভর করে আরও ৪-৫% ভোট বাড়াতে পারলে বিজেপি বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের খেলা কঠিন করে দিতে পারে। কিন্তু প্রথম দিকে শুভেন্দুর এই সুরের সঙ্গে প্রকাশ্যে একমত হননি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ও দলের একাংশ। সূত্রের খবর, কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রভাবশালী অংশেরও ধারণা, হিন্দু ভাবাবেগ এ রাজ্যে দলের ভাল অস্ত্র হতে পারে। তাঁদের মতে, বাঙালি জনমানসে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র যে প্রথাগত ধারণা ছিল, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপরে নিপীড়নের ঘটনা তাতে ধাক্কা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে হিন্দু জনসমর্থন বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ আছে বিজেপির সামনে। দলের ওই অংশের বক্তব্য, হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনে প্রত্যাশা ছাপিয়ে বিজেপির ভাল ফলের নেপথ্যে বাংলাদেশের ঘটনারও প্রভাব আছে, এমন বিশ্লেষণ উঠে এসেছে দলের অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনায়।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘বাংলায় যে ৩৮% মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন, তাঁরা তৃণমূল সরকারের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-সহ বিভিন্ন প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও আমাদের সমর্থন করেছেন। তার মানে শুধু সরকারি প্রকল্পেই সব রাস্তা বন্ধ নয়। হিন্দুদের অধিকারের প্রশ্নে ঠিকমতো সরব থাকলে আরও মানুষের সমর্থন আমাদের দিকে আসবে না, এটা মনে করার কারণ নেই।’’ বিজেপি সূত্রের ইঙ্গিত, হিন্দু মনে নজর রেখে সাযুজ্যপূর্ণ কৌশল নিয়েই এগোতে চাইবে দল।
তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেবল ‘তোষণের রাজনীতির কারিগর’ বলে আখ্যা দিয়ে হিন্দুত্বের তাস হাতে বিজেপি বাজিমাত করে ফেলবে, এটাও সহজে ধরে নেওয়া যাবে না বলে সতর্ক থাকছেন দলীয় নেতৃত্বের ওই অংশ। তাঁদের নজরে এসেছে, বাংলাদেশ-প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী বারেবারেই কেন্দ্রীয় সরকারের মত মেনে চলার কথা বলেছেন। হিন্দু জনতার কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে, এমন কোনও কথাও বলেননি। ফলে, মমতার রাজনৈতিক কৌশলের মোকাবিলা করেই লড়তে হবে বিজেপিকে। তৃণমূল কংগ্রেসের এক রাজ্য নেতারও দাবি, ‘‘বাংলাদেশে ঘটনার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব নরেন্দ্র মোদীর সরকারের। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য সরকার এবং আমাদের দলের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এখানে বিজেপির আস্ফালনে কাজ কিছু হবে না!’’
হিন্দুত্বের অস্ত্র নিয়ে এগোনোর সময়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কাজকর্ম নিয়ে জবাবদিহির বিড়ম্বনা অবশ্য এড়াতে পারছে না বিজেপি। আর জি করের ঘটনার পরে নাগরিক আন্দোলনে বামেদের যা প্রভাব ছিল, বিজেপি সেখানে পৌঁছতে পারেনি। এখন সিবিআই তদন্তের ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তার ‘দায়’ও পদ্ম শিবিরকে নিতে হচ্ছে! তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা দুর্নীতির মামলায় একের পর এক অভিযুক্তের জামিন। তথাগত রায়ের মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতাকেও বলতে হচ্ছে, জনমানসে ‘সেটিং’ সংক্রান্ত যে সব প্রশ্ন উঠছে বিজেপির এক জন প্রাক্তন নেতা হিসেবে তার জবাব দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শাহের উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, ‘‘মা কালীর দোহাই, কিছু করুন, কিছু বলুন! বাংলায় ২০২৬ সালের নির্বাচনের আর বছরখানেক বাকি। বিজেপি তো মুছে যাবে!’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত-সহ দলের রাজ্য নেতৃত্ব অবশ্য যুক্তি দিচ্ছেন, আর জি করের ঘটনায় তথ্য-প্রমাণ লোপাট করা হয়েছে বলেই সিবিআইয়ের কাজ কঠিন হয়েছে।