গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
চলতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনের আগে সক্রিয় কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি। তাই ঝাড়খণ্ডে বিরোধী থেকে শাসকের আসনে ফিরতে মরিয়া বিজেপি নেমেছে তাদের অতি পরিচিত কৌশল ‘অপারেশন লোটাস’-এ। সেই কাজে তারা ব্যবহার করছে দেশের পূর্বাঞ্চলের দুই রাজ্যের দু’জন নেতাকে। প্রথম জন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং অন্য জন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বিজেপি সূত্রে খবর, আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপি ঝাড়খণ্ডের দায়িত্ব দিয়েছে হিমন্তকে। কিন্তু, শুভেন্দুকে গোটা অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অন্তরালে থেকে। দল দায়িত্ব দেওয়ার পরেই দুই নেতাই সক্রিয় হয়ে নেমে পড়েছে ভোটযুদ্ধের প্রাক্-প্রস্তুতি পর্বে। হিমন্ত যেমন রাঁচী গিয়ে সরাসরি কাজকর্ম শুরু করেছেন, শুভেন্দু আবার কলকাতা থেকেই দলকে ক্ষমতায় আনার কাজ করছেন নীরবে।
বিজেপি পরিষদীয় দল সূত্রে খবর, গত শনিবার চুপিসারে কলকাতায় এসেছিলেন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম)-এর বিদ্রোহী নেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চম্পই সোরেন। কলকাতায় এসে তিনি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর গোপন ডেরায় তাঁর সঙ্গে বৈঠক করে যান। তবে এই বৈঠকের কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে কেউই স্বীকার করেননি। বরং রবিবার সকালে জেএমএমের ছয় বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে দিল্লিতে যান চম্পই। জল্পনা ছড়ায়, বিজেপিতে যোগ দেওয়ার জন্যই দিল্লি গিয়েছেন হেমন্ত সোরেনের দলের এই প্রবীণ নেতা। তবে চম্পই জানিয়েছিলেন, ‘ব্যক্তিগত কারণে’ই তাঁর এই দিল্লি সফর। আর রবিবার বিকেলে এক দীর্ঘ পোস্টে নিজের যন্ত্রণার কথা লিখেছিলেন ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর পোস্টের ছত্রে ছত্রে ছিল ‘অপমান এবং লাঞ্ছনা’র ইতিবৃত্ত। সেই পোস্টেই চম্পই নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়েও জানান। তিনি তিনটি বিকল্পের কথা লিখেছিলেন। তার প্রথমটি হল, রাজনীতি থেকে অবসর। দ্বিতীয়, নিজে কোনও দল বা সংগঠন তৈরি করা। আর শেষটি হল, ‘নতুন পথে সঙ্গী’ পাওয়া গেলে, তাঁর সঙ্গেই বাকি পথটা হাঁটা। এই তৃতীয় বিকল্প নিয়েই যত আলোচনা। রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, কলকাতায় শুভেন্দুর সঙ্গে চম্পাইয়ে বৈঠক যে ফলপ্রসূ হয়েছে, তার প্রমাণ পেয়েছেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। আর তাই কালবিলম্ব না করে সোমবার সকালেই শুভেন্দুকে দিল্লি তলব করেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দলের তলবেই সোমবার সকালের বিমানে দিল্লি গিয়েছেন শুভেন্দু।
বিজেপি সূত্রে খবর, হিমন্ত এবং শুভেন্দুর রাজনৈতিক বিচক্ষণতাকে কাজে লাগাতে চাইছে দল। কংগ্রেস রাজনীতিতে যুক্ত থাকার সময় থেকেই দেশের পূর্বাঞ্চলের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন অসমের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। আর তৃণমূলে থাকাকালীন শুভেন্দু জঙ্গলমহলের জেলাগুলির দায়িত্বে ছিলেন দীর্ঘ সময়। ফলে তাঁর সঙ্গে আদিবাসী সমাজের যোগাযোগ রয়েছে বেশ ভাল স্তরে। সেই সুবাদে ঝাড়খণ্ডের রাজনীতি প্রসঙ্গেও তিনি বেশ অবগত। তাই আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ঝাড়খণ্ডে ফের পদ্মফুল ফোটাতে বিজেপি ভরসা রাখছে হিমন্ত-শুভেন্দু জুটির উপর। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে বিজেপিতে যোগদান করেছেন শুভেন্দু। তার পর থেকে বিজেপির ভিন্রাজ্যে থাকা যে নেতাদের সঙ্গে তাঁর ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তাঁদেরই একজন হলেন হিমন্ত।
২০২২ সালে যখন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে উপরাষ্ট্রপতি পদে ভোটে প্রার্থী করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, তখন তৃণমূলের সমর্থন আদায়ের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তকে। দল তাঁকে দায়িত্ব দেওয়ার পরেই হিমন্ত যোগাযোগ করেন শুভেন্দুর সঙ্গে। তাঁর কাছে পরামর্শ চান যে, বিজেপির তরফে কি কলকাতায় এসে তিনি মমতার সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন? এমন আলাপচারিতায় শুভেন্দু তাঁকে জানিয়েছিলেন, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর যে ভাবে শাসকদল তৃণমূলের হাতে বিজেপির নেতা, কর্মী ও সমর্থকেরা আহত এবং নিহত হয়েছেন, তাতে হিমন্তের মতো কোনও বিজেপি নেতা যদি কলকাতায় এসে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন, তাতে দল তথা বাংলার জনমানসে ভুল বার্তা যাবে। তাই কলকাতার থেকে অনেক দূরে কোথাও এই বৈঠক হলে তাঁদের আপত্তি নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলার সমতল ভূমির তুলনায়, দার্জিলিঙের পাহাড়ের সেই বৈঠক করার প্রস্তাব দেন শুভেন্দুই। বিবেচনা এবং আলোচনার পর হিমন্ত সেই বৈঠক করেছিলেন দার্জিলিঙেই। তাই এই সব সমীকরণের কথা মাথায় রেখেই হিমন্ত-শুভেন্দু জুটিতেই ঝাড়খণ্ডের ক্ষেত্রেও ভরসা রাখছে বিজেপি।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ জানুয়ারি ঝাড়খণ্ডে জমি দুর্নীতি সংক্রান্ত বেআইনি আর্থিক লেনদেন মামলায় ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্তকে গ্রেফতার করেছিল ইডি। গ্রেফতারির আগে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। হেমন্তের অনুপস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী হন তাঁর মন্ত্রিসভার পরিবহণমন্ত্রী চম্পই। পাঁচ মাস রাঁচীর বিরসা মুন্ডা জেলে বন্দি থাকার পরে গত ২৮ জুন ঝাড়খণ্ড হাই কোর্টের নির্দেশে মুক্তি পান হেমন্ত। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবারও মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তিনি। পদ ছাড়তে হয় চম্পইকে। তবে তাঁকে রেখে দেওয়া হয় মন্ত্রিসভায়। শোনা যাচ্ছিল, মুখ্যমন্ত্রিত্ব হারানোর পর দলের মধ্যেও নাকি কোণঠাসা চম্পই। এর পরেই বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে নতুন রাজনীতির পথ অনুসন্ধান করছেন আদিবাসী নেতা চম্পই। এই কাজে তাঁকে সহযোগিতা করছেন হিমন্ত-শুভেন্দু।