মুর্শিদা খাতুন। —নিজস্ব চিত্র।
সামনে বসে ১৮৪ জন আইএএস। হাতে নোটবুক, পেন। অপেক্ষা ‘ম্যাডাম’ কী বলবেন তা শোনার জন্য।
ম্যাডাম বসে উল্টো দিকের চেয়ারে। গলাটা কি শুকিয়ে যাচ্ছে? ঈষৎ কাঁপছে বাঁ পা-টা? সামনে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা যে সব হবু আমলা! তাঁর মনে পড়ে, সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে মুসৌরির এই যাত্রাপথটাও তো সহজ ছিল না। তা হলে? ম্যাজিকের মতো মিলিয়ে যায় ভয়। টানটান উঠে দাঁড়ান মুর্শিদা খাতুন।
নাবালিকার বিয়ে থেকে, মাদ্রাসার লেখাপড়া, গ্রামীণ রাজনীতি থেকে সালিশির প্রভাব— হিন্দি ও ইংরেজিতে বলে চলেন তিনি। বরাদ্দ ৪৫ মিনিট কখন যে এক ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে টেরই পাননি কেউ। মুর্শিদা থামলেন। অডিটোরিয়ামে হাততালি। মুর্শিদাবাদের দেবকুণ্ডু শেখ আব্দুর রাজ্জাক মেমোরিয়াল গার্লস হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষিকা মুর্শিদা বলছেন, ‘‘এই অভিজ্ঞতা ভুলব না।’’
মুসৌরির লালবাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এ কয়েকটি ধাপে প্রশিক্ষণ নেন আইএএস, আইপিএস, আইএফএস আধিকারিকেরা। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের আমন্ত্রণ পেয়ে ১৪ মার্চ সেখানে যান মুর্শিদা। বলছেন, ‘‘আমাকে বলা হয়েছিল, গাঁ-গঞ্জের রুখু বাস্তবটা তুলে ধরতে। আমার নানা অভিজ্ঞতা ওঁদের সঙ্গে ভাগ করেছি।’’ কিন্তু, মুর্শিদাকেই কেন বাছা হল? উত্তর জানে পিছিয়ে পড়া জেলা, মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদা তখন ষষ্ঠ শ্রেণি। গাঁয়ের মাতব্বরেরা তাঁর বিয়ে ঠিক করলেন। তাঁদের যুক্তি, ‘বয়স বেড়ে গেলে আর বেশি পড়াশোনা করলে বর জুটবে কী করে?’ সেই বয়সেই না বলে দিয়েছিলেন মুর্শিদা। বেলডাঙার মির্জাপুরের সেই মেয়ে অঙ্কে এমএ পাশ দিয়ে এখন প্রধান শিক্ষিকা। এলাকার মেয়েদেরও বড় ভরসা ‘মুর্শিদা আপা।’ নাবালিকার বিয়ে? নাওয়া-খাওয়া ভুলে ছুটছেন মুর্শিদা। শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতন? নিগৃহীতাকে সঙ্গে করে থানা-পুলিশ-প্রশাসনের দোরে দোরে ঘুরছেন মুর্শিদা।
আরও পড়ুন: দোহাই আমাদের মেরো না, বনবান্ধব হতে বাঘের আর্তি
মুর্শিদার ভরসায় হাজারো বাধা ডিঙিয়ে জাতীয় স্তরের সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় যোগ দেয় তাঁর মাদ্রাসার মেয়েরা। টানা দু’বছর তারাই রাজ্য চ্যাম্পিয়ন। ডিসেম্বরে দিল্লিতে বেসরকারি সংগঠন আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘ফিয়ারলেস গার্ল’– এর সম্মান পানও মুর্শিদা।
ওই অনুষ্ঠানেই ছিলেন আইএএস অ্যাকাডেমির ডেপুটি ডিরেক্টর অশ্বথী এস। মুর্শিদায় মুগ্ধ হয়ে সেখানেই ‘রিসোর্স পার্সন’ হিসাবে তাঁকে মনোনীত করেন। মুর্শিদা বলেন, ‘‘যে দিন আমলারা সত্যিই মেঠো সমস্যা বুঝতে পারবেন, সে দিন দেখবেন, দেশটাই বদলে গিয়েছে।’’