জলমগ্ন শহর। রাস্তায় পড়ে গেলেন দুই স্কুটার আরোহী। সোমবার মোমিনপুরে। ছবি: সুমন বল্লভ
রবিবার রাত থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত নাগাড়ে অতি প্রবল বৃষ্টি। এর তীব্রতম ঝাঁঝ আবার রাত ১টা থেকে সকাল ৬টার মধ্যে। একই সময়ে জোয়ারে কলকাতায় গঙ্গার জলস্তর ১৮ ফুটের শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছে। তার জেরে লকগেট খুলে রাতের শহরের জমা জল মুক্ত করতে দিশাহারা হয়ে পড়ে পুর-প্রশাসন। ফলে, সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনের শুরুতেই প্রবল দুর্ভোগের শিকার কলকাতা। একই সঙ্গে হাওড়া, দুই ২৪ পরগনা, নদিয়া থেকে মেদিনীপুর— দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অংশেই চিরকালীন জলযন্ত্রণার ছবিটা ফিরে এল।
নবান্নে ২৪ ঘণ্টার কন্ট্রোল রুম চালু করে (টোল ফ্রি নম্বর ১০৭০, ২২১৪৩৫২৬) পরিস্থিতির দিকে নজর রাখতে হচ্ছে। মেদিনীপুর ও দক্ষিণবঙ্গে ৫৭৭টি ত্রাণশিবিরে এক লক্ষ ৪১ হাজার মানুষকে সরাতে হয়েছে বলেও নবান্ন সূত্রের খবর। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে মোট ৪৭টি ব্লক এবং ৮টি পুর-এলাকা জলমগ্ন। ১৩ লক্ষ ১৪ হাজার ৩১৮ জন জলবন্দি বলে নবান্নের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের রিপোর্ট। পূর্ব মেদিনীপুরের জলমগ্ন পটাশপুরে সাপের ছোবলে এক কিশোরী মারাও গিয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে। প্লাবিত এলাকাগুলিতে করোনা টিকাকরণ শিবির বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
রবিবার রাত একটা থেকে সোমবার বেলা দু'টো পর্যন্ত কলকাতার বেশিরভাগ জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে গড়ে প্রায় দেড়শো মিলিমিটার করে। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে ধাপা লক পাম্পিং স্টেশন এলাকায় (১৯০ মিলিমিটার)। কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে ১২৭ মিলিমিটারই সকাল ছ’টার আগে হয়েছে। পুরসভা জানিয়েছে, জোয়ারের জন্য রবিবার রাত এগারোটা থেকে ভোর তিনটে এবং ফের সোমবার সকাল সাড়ে দশটা থেকে বিকেল তিনটে পর্যন্ত গঙ্গা লাগোয়া লকগেটগুলি বন্ধ থাকায় বৃষ্টির জমা জল সরতে দেরি হয়েছে।
পুরসভা সূত্রের খবর, ভারী বৃষ্টির সময় জল সরানোর জন্য গঙ্গায় ৮টি লক গেট রয়েছে। এর পাঁচটি উত্তরে এবং তিনটি দক্ষিণ কলকাতায়। লকগেট খোলা থাকলে শহরের জমে থাকা জল লকগেটের মাধ্যমে গঙ্গায় গিয়ে পড়ে। কিন্তু রাতের শহরে লকগেট খোলা যায়নি। কলকাতায় পুরপ্রশাসক মণ্ডলীর সদস্য তারক সিংহ বলেন "রবিবার রাতে ও সোমবার সকালে গঙ্গায় জোয়ারের সময় গঙ্গার জলস্তর ১৮ ফুট পর্যন্ত উঁচুতে উঠেছিল। জোয়ারের সময় লকগেটগুলি বন্ধ না রাখলে জোয়ারের জল শহরের নিকাশি নালার মাধ্যমে ঢুকে হিতে বিপরীত হত। তাই মানুষের দুর্ভোগ বাড়লেও বিকেল পর্যন্ত লকগেট খুলতে পারিনি।" এই পরিস্থিতিতে আলিপুর, বালিগঞ্জ, পার্ক সার্কাস, আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে শুরু করে উত্তর, দক্ষিণ বা বেহালার দিকের নানা অঞ্চলই জল জমে নাস্তানাবুদ হয়।
রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিতে পূর্ব মেদিনীপুরের জলমগ্ন এলাকার পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। ভরা কটালের জোয়ারে ফুঁসছে রূপনারায়ণ ও হলদি। কেলেঘাইয়ের জলে প্লাবিত ভগবানপুর-২ ব্লকের ইটাবেড়িয়া-সহ একাধিক গ্রাম। পশ্চিম মেদিনীপুরে সবং, পিংলা, নারায়ণগড়, ডেবরা, কেশপুরের কিছু এলাকা এখনও জলমগ্ন। জেলায় দুর্গতের সংখ্যা ছ’লক্ষ ছাড়িয়েছে। তিনশোর বেশি ত্রাণ শিবিরে রয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
হাওড়ার বাগনান, উলুবেড়িয়া, আমতা প্রভৃতি শহরে জল দাঁড়িয়ে যায়। বাগনান গ্রামীণ হাসপাতালের সামনেও জল জমে। দুপুর থেকে মুষলধারে বৃষ্টিতে হুগলির চন্দননগর, ব্যান্ডেল, ভদ্রেশ্বর-সহ শহরের বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। নদিয়ায় রানাঘাট, চাকদহ, কল্যাণী, হরিণঘাটায় দিনভর টানা বৃষ্টি হয়েছে। কল্যাণী ছাড়া, প্রায় সর্বত্র নিচু এলাকায় জল জমেছে।
বৃষ্টিতে চাষের ক্ষতি হয়েছে দুই ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায়। হাবরা, বনগাঁ শহরের একাধিক এলাকায় জল জমেছে। জলে ভাসছে বসিরহাট মহকুমার বড় অংশ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর চুনাখালিতে নদী-বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক জায়গায় বাঁধে ধস নামতে শুরু করেছে। জেলার প্রায় দশ হাজার মানুষকে ৬৮টি ত্রাণ-শিবিরে সরানো হয়েছে। ৩৭টি মাটির বাড়ি সম্পূর্ণ ও ৪১৯টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত।