মৃদুলা বড়াল ও শিপ্রা গুছাইত।
যে হাতে শিশুদের টিকা দিয়েছেন, সেই হাত পেতে ভিক্ষা করতে প্রথম প্রথম অপমানে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করত শিপ্রা গুছাইতের। কিন্তু পেটের জ্বালায় বেশি দিন সেই লজ্জা থাকেনি। এখন উল্টোডাঙার রাস্তায় ভিক্ষা করেন দক্ষিণ দমদম পুরসভার ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের এই অবসরপ্রাপ্ত পুর স্বাস্থ্যকর্মী।
বিধাননগর পুরনিগমের ৫ নম্বর সাব-সেন্টারের অবসরপ্রাপ্ত পুর স্বাস্থ্যকর্মী মৃদুলা বড়ালের বাড়িতে শয্যাশায়ী অশীতিপর মা, অসুস্থ বোন আর তিনি। কোনও রোজগার নেই। ২০১৭ সালে অবসরের পরে ভিক্ষা করে এক বেলার খাবার জোটান তিনি। হুগলির উত্তরপাড়া-কোতরং মিউনিসিপ্যালিটির দুই অবসরপ্রাপ্ত পুর স্বাস্থ্যকর্মী কৃষ্ণা ঘোষ ও শিখা ভট্টাচার্যকেও শেষ পর্যন্ত ভিক্ষাবৃত্তি করে পেট চালাতে হচ্ছে। রাজ্য
জুড়ে একই অবস্থায় রয়েছেন এমন আরও অনেকে।
পশ্চিমবঙ্গের ১২৮টি পুরসভা ও নিগমে কর্মরত পুর স্বাস্থ্যকর্মীদের তরফে গত কয়েক মাসে পুর নগরোন্নয়নমন্ত্রী এবং ‘স্টেট আর্বান ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি’ বা ‘সুডা’র অধিকর্তার সঙ্গে দেখা করে জানানো হয়েছে, অত্যন্ত কম বেতন এবং অবসরকালীন ভাতার অভাবে এ ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকে অবসরের পর ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে বাধ্য হচ্ছেন।
এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৭ হাজার পুর স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। শহরাঞ্চলে জননী সুরক্ষা যোজনা, জননী-শিশু সুরক্ষা যোজনা, শিশুদের টিকাকরণ, জন্ম নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের দায়িত্বে রয়েছেন এঁরা। প্রত্যেকে অভাবী পরিবারের এবং এঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অবিবাহিত, স্বামীহারা, ডিভোর্সি, অনেকের আবার স্বামী অসুস্থ বা নিরুদ্দেশ। এঁদের বেতন মাসে ৩১২৫ টাকা। সরকারি খাতায় এঁরা ‘স্বেচ্ছাসেবক’। ফলে সরকারি আর্থিক সুবিধা বা অবসরকালীন ভাতা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। পশ্চিমবঙ্গ পৌর স্বাস্থ্য কর্মী সংগঠনের রাজ্য সভাপতি সুচেতা কুণ্ডু জানান, এত কম বেতনে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় অসম্ভব। তার উপর অবসরের সময় কোনও টাকা না পাওয়ায় ৬০ বছরের পরে ভিক্ষা ছাড়া অনেকেরই পথ থাকছে না। এঁরা নিযুক্ত হয়েছিলেন মূলত আশির দশকের শেষে, ফলে ২০১৫-র পর থেকে অবসর শুরু হয়েছে। সমস্যা প্রকট হয়েছে তখনই।
গত ২৭ জুন বিভাগীয় মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে দেখা করে এই স্বাস্থ্যকর্মীরা চাকরির মেয়াদ ৬৫ বছর করা ও অবসরকালীন ভাতা দেওয়া-সহ একাধিক দাবি জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু গত ৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রী জানিয়েছেন যে, অর্থ দফতর ৬৫ বছরে অবসরের দাবি খারিজ করে দিয়েছে। ভাতার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়নি। ফিরহাদ হাকিম এই মুহূর্তে বিদেশে। তাঁর দফতরের সচিব সুব্রত গুপ্ত বলেন, ‘‘পুর স্বাস্থ্যকর্মীদের বিষয়ে অনেক প্রস্তাব অর্থ দফতরে পাঠানো হয়েছিল। ৬৫-তে অবসরের বিষয়টি গৃহীত হয়নি। অবসরকালীন ভাতার বিষয়টি বিবেচনাধীন। এঁদের স্বাস্থ্য দফতরের আওতায় আনার ব্যাপারেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’’
স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, ২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর অর্থ দফতর থেকে সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করে অস্থায়ী, দৈনিক মজুরিপ্রাপ্ত ও চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের জন্য অবসরের পরে এককালীন ২ লক্ষ টাকা ভাতার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু পুর স্বাস্থ্যকর্মীরা সরকারি খাতায় ‘স্বেচ্ছাসেবক’, তাই এই সুবিধা থেকে বাদ পড়েন।