কচুবেড়িয়ায় বাসে ওঠার ভিড় পুণ্যার্থীদের। ছবি: সমরেশ মণ্ডল
সংক্রমণের রেখচিত্র নীচের দিকে নামছে, এমন নয়। বরং আজ একটু নিম্নমুখী তো পরের দু’দিন ফের তা ঊর্ধ্বমুখী। এমন করেই বঙ্গের ময়দানে কার্যত প্রতিদিনই নিজের দাপট বাড়িয়ে চলেছে করোনা সংক্রমণ। চিকিৎসকেরা বলছেন, সংখ্যাটা এখন আর বিবেচ্য নয়। সকলেই আক্রান্ত হতে পারেন যখন-তখন। তাই দরকার সতর্কতা আর কোমর্বিডিটিতে ভোগা মানুষজনের উপরে নজরদারি।
স্বাস্থ্য দফতরের বুধবারের বুলেটিন বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় অর্থাৎ মঙ্গলবার রাজ্যে নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন ২২,১৫৫ জন। রেখচিত্রে দেখা যাচ্ছে, ৮ জানুয়ারি, শনিবার (৯ জানুয়ারির বুলেটিনে প্রকাশিত) রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৪,২৮৭। পরের দিন, রবিবার সংক্রমণ অনেকটা কমে হয় ১৯,২৮৬। তার পরে সংক্রমণ যেমন আর কমেনি, তেমনই ২৪ হাজারকে ছাপিয়েও যায়নি। সোমবার রাজ্যে আক্রান্ত হন ২১,০৯৮ জন। তার থেকে কিছুটা বাড়ে মঙ্গলবার। যদিও করোনা পরীক্ষা ও আক্রান্তের আনুপাতিক হারের হিসেবে সোমবারের (৩২.৩৫ শতাংশ) থেকে মঙ্গলবারের পজ়িটিভিটি রেট কমে হয়েছে ৩০.৮৬ শতাংশ।
তবে রেখচিত্রের এই ওঠানামা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে রাজি নন বঙ্গের চিকিৎসক মহলের অধিকাংশই। তাঁদের মতে, করোনা পরীক্ষার উপরে আক্রান্তের সংখ্যা এখন আর নির্ভরশীল নয়। কারণ, সকলে পরীক্ষা করাচ্ছেন না। আইসিএমআর-ও জানিয়ে দিয়েছে, উপসর্গহীন এবং পজ়িটিভ রোগীর সংস্পর্শে আসা লোকজনের পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। প্রত্যেকেই আজ বা কাল সংক্রমিত হতে পারেন। চিকিৎসকদের আরও দাবি, ১৯ হাজার এবং ২২ হাজারের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। সেটি দু’হাজার এবং ২২ হাজার হলে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হত। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ যোগীরাজ রায় বলেন, “এখন সংক্রমণকে সংখ্যার দিক থেকে বিচার করা ঠিক নয়। এখন সংক্রমণের সংখ্যা উপরের দিকেই থাকবে। কারণ, একটি স্থিতাবস্থায় আসার আগে সকলে আক্রান্ত হবেন বা হচ্ছেন।”
ওমিক্রনের মতো ভেরিয়েন্ট যে-হারে সংক্রমণ ছড়াতে পারে, তাতে আজ না-হলেও আগামী দিনে রাজ্যের ছয় থেকে ন’কোটি মানুষ সংক্রমিত হবেন বলে আশঙ্কা করছেন কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্কের উপদেষ্টা চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী। তিনি বলেন, “কত মানুষ দৈনিক সংক্রমিত হচ্ছেন, সেটা নিয়ে ভাবিত নই। বরং এই সংক্রমণের সঙ্গে যাঁরা আগে থেকে অন্য রোগে ভুগছেন, তাঁরা কতটা সঙ্কটজনক হয়ে পড়লেন এবং তাঁদের কতটা চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হল, সেটা সব থেকে বড় বিষয়।”
একই মত রাজ্যে করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান চিকিৎসক গোপালকৃষ্ণ ঢালির। তাঁর ব্যাখ্যা, এখন যত জন পরীক্ষা করাবেন, তাঁদের অধিকাংশের রিপোর্ট পজ়িটিভ আসবে। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগের মৃদু উপসর্গ থাকায় তেমন চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ছে না। কিন্তু বয়স্ক ও কোমর্বিডিটি থাকা মানুষদের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, করোনা সংক্রমিত হওয়ার পরে তাঁদের পুরনো রোগের কারণে প্রাণসংশয় না-হয়।
শল্যচিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার বলেন, “করোনা আক্রান্ত হয়েও যাতে পুরনো রোগের চিকিৎসায় খামতি না-থাকে, সেটা খেয়াল রাখা এখন সব থেকে বেশি জরুরি। সংখ্যার বিচারে এখন সংক্রমণকে দেখলে ভুল হবে।” তিনি জানাচ্ছেন, শহরের সংক্রমণ এখন একটা স্থিতাবস্থার মধ্যে চলছে। গোষ্ঠী সংক্রমণ বা পারিবারিক সংক্রমণের জেরে এখন কলকাতা, সংলগ্ন এলাকা এবং অন্যান্য জেলায় আক্রান্তের সংখ্যার উত্থান-পতন চলবে। এ দিনের বুলেটিন অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার) কলকাতায় আক্রান্ত হয়েছেন ৭০৬০ জন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকও জানিয়ে দিয়েছে, দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি পজ়িটিভিটি রেট কলকাতায়। তার পরেই রয়েছে রাজ্যের অন্য কয়েকটি জেলা। মঙ্গলবার আক্রান্তের সংখ্যা ১০০-র নীচে ছিল মাত্র তিনটি জেলায়— আলিপুরদুয়ার (৭৮), কালিম্পং (৫১), কোচবিহার (৮৬)। ওই দিন করোনায় মারা গিয়েছেন ২৩ জন। চিকিৎসকেরা জানান, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে সঙ্কটজনক রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়বে, মৃতের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। সেটাই স্বাভাবিক। তবে দেখতে হবে, মৃত্যুর নেপথ্যে আসল কারণ কী। রোগীর কোমর্বিডিটি ছিল কি না।
চিকিৎসা পরিকাঠামোয় খামতি রাখতে নারাজ স্বাস্থ্য দফতর। এ দিন সব হাসপাতাল, জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বাস্থ্যকর্তারা। সেখানে অক্সিজেন প্ল্যান্টের সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শিশুদের ভেন্টিলেটর এবং অন্যান্য যন্ত্র যাতে ঠিকঠাক কাজ করে, সে-দিকেও নজর রাখতে বলা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য শিবির সূত্রের খবর।