বাঁ দিক থেকে, কাকলি, সখিনা ও ইলা রায়চৌধুরী। ফাইল চিত্র
চিলতে বাড়িতে ওঁরা ‘বেঁধে বেঁধে’ই আছেন! গত প্রায় তেরো মাস ধরে হাজার ঝড়-ঝাপটাও ওঁদের সেই বাঁধন ছিঁড়তে পারেনি। নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে আর পাঁচ জনের মতো তাঁরা উদ্বিগ্ন থাকলেও হাল ছাড়তে রাজি নন কেউই। বাড়ির কর্ত্রী ইলা রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘আইন যা-ই হোক না কেন, কোনও আইন আমাদের আলাদা করতে পারবে না।’’ আর সখিনা বিবির কথায়, ‘‘এই নতুন আইনের মারপ্যাঁচে কোথাও যেতে হলে একসঙ্গেই যাব। মরতে হলেও একসঙ্গেই মরব। কিন্তু আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।’’
দেশ জুড়ে বিভাজনের রাজনীতির চেষ্টা চললেও হরিহরপাড়ার চোঁয়া গ্রামের এক গরিব যজমান আজ কয়েক মাস ধরে কন্যাসম সখিনা বিবিকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে মানবধর্মের পক্ষেই সওয়াল করে আসছেন। এক সময় যাঁরা সুভাষ রায়চৌধুরী নামে ওই যজমানের বিপক্ষে ছিলেন তাঁদের অনেকেই এখন বলছেন, ‘‘সুভাষ কিন্তু আমাদের গ্রামের গর্ব।’’
তখনও এনআরসি-র আঁচ এ বঙ্গে তেমন ভাবে পড়েনি। তখনও নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে শুরু হয়নি হইচই। ঠিক এমন আবহে হরিহরপাড়ায় গ্রামবাসীদের একাংশের নিষেধ-আপত্তি উপেক্ষা করে দুই নাবালক বাচ্চা-সহ এক অসহায় মুসলমান তরুণীকে নিজের ঘরে ঠাঁই দেন গরিব যজমান সুভাষ।
জলঙ্গির সখিনাকে প্রায় এক কাপড়ে তাড়িয়ে দেন তাঁর স্বামী। দুই নাবালক পুত্র-কন্যা নিয়ে রাস্তায় বসে থাকা সেই তরুণীকে ঘরে নিয়ে এসেছিলেন সুভাষবাবুর কন্যা কাকলি। বিবাহ বিচ্ছেদের পরে কাকলিও থাকেন বাপের বাড়িতেই। কাকলির কথা শুনে সুভাষও রাজি হন সখিনাকে বাড়িতে আশ্রয় দিতে। আর তার ফলে, গ্রামে তাঁদের প্রায় ধোপা নাপিত বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল।
তার পরে গত প্রায় তেরো মাস থেকে ওই রায়চৌধুরী বাড়িতে মেয়ে হিসেবেই থেকে গিয়েছেন সখিনা বিবি। সখিনাও সুভাষকে বাবা বলেই ডাকেন। সময় এখন অন্য দিকে মোড় নিয়েছে। নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দেশ জুড়ে চলছে হইচই, আন্দোলন, বিক্ষোভ। ক্ষোভের আগুন জ্বলেছে মুর্শিদাবাদেও। প্রতিবাদের নামে জেলার বেশ কিছু জায়গায় চলেছে তাণ্ডবও। উদ্বিগ্ন হয়ে বহু মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্রয়োজনীয় নথিপত্র। বেশ কয়েক জন নথিপত্র জোগাড় করতে না পেরে ভয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েও মারা গিয়েছেন।
সেই উদ্বেগের ছাপ পড়েছে রায়চৌধুরী বাড়িতেও। সখিনার বাবার বাড়ি জলঙ্গি এলাকায়। পদ্মার গ্রাসে তলিয়ে গিয়েছে তাঁর বাবার ভিটেমাটি। ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন সখিনার বাবা-মা। তিন দাদা ডোমকল- জলঙ্গি রাজ্য সড়কের পাশে ফুটপাতে বাস করেন। সখিনার কাছে কাগজপত্র বলতে রয়েছে ভোটার কার্ড ও আধার কার্ড। তাই দিয়ে কী ভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণ হবে সেই চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে সখিনাকেও।
মাত্র তেরো বছর বয়সে বাবা, মা ও দুই দাদার সঙ্গে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে এ রাজ্যে উদ্বাস্তু হিসেবে আসেন সুভাষ রায়চৌধুরী। ২৪ পরগনার অশোকনগরে কয়েক বছর বসবাসের পরে এক দাদা খড়দহ ও আর এক দাদা দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে থাকতে শুরু করেন। সুভাষ হরিহরপাড়ার চোঁয়া এলাকায় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। ফলে সুভাষেরও নথি বলতেও সম্বল শুধু ভোটার আর আধার কার্ড। সুভাষের স্ত্রী ইলা চোঁয়া গ্রামেরই মেয়ে। ফলে তাঁর অন্য নথিপত্র রয়েছে।
সুভাষ বলছেন, ‘‘এই এক জন্মেই ক’বার দেশ ছাড়তে হবে, কে জানে! তবে দেশ যদি ছাড়তেই হয় সবাইকে সঙ্গে নিয়েই ছাড়ব।’’ আর সখিনা? সুভাষ হাসছেন, ‘‘সবার মধ্যে তো সখিনাও রয়েছে। ও তো আমার ছোট মেয়ে।’’