দুর্গাবাঁধে কৃষি দফতরের বীজ খামার। ছবি: কৌশিক সাঁতরা।
নেহাত লগ্নির আহ্বান নয়, এ রাজ্যে গাড়ি শিল্পে টাটারা যাতে বিনিয়োগ করে, সে জন্য সরকারি প্রস্তাব পাঠানোর তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গেল।
বুধবার সিঙ্গুর উৎসবের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টাটা মোটর্সকে গোয়ালতোড়ে গাড়ি কারখানা করার ডাক দিয়েছিলেন। সেই মতো গোয়ালতোড়ের এক হাজার একর সরকারি জমিতে ‘অটো হাব’ গড়ার জন্য দু’-এক দিনের মধ্যেই শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র টাটাদের সরকারি ভাবে প্রস্তাব পাঠাবেন। শিল্প দফতরের খবর, টাটাদের সরকারিভাবে আহ্বান জানানোর জন্য শিল্পমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই নির্দেশ মেনেই অমিতবাবু আমন্ত্রণ জানাবেন টাটাদের।
শিল্প দফতরের এক কর্তা বৃহস্পতিবার জানান, টাটাদের যাবতীয় পরিকাঠামো দিতে প্রস্তুত রাজ্য। পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড়ে ওই এলাকায় পৌঁছতে চওড়া
পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ, জল— সবেরই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রাস্তা বানাবে পূর্ত দফতর। তার বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্টও (ডিপিআর) তৈরি হয়ে গিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনাও এ দিন বলেন, ‘‘কৃষি দফতরের ওই জমি ইতিমধ্যেই রাজ্য শিল্প উন্নয়ন নিগমের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওখানে বিদ্যুতের আলাদা সাবস্টেশন, রাস্তার জন্য টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। দ্রুত কাজ শুরু হবে।’’
শিল্প দফতরের আশা, টাটারা এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব নেবে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় তেমন ইঙ্গিতও মিলেছে। দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘টাটা স্টিল কর্তা টি ভি নরেন্দ্রন জার্মানিতে মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। টাটা মেটালিক্সের কর্তা সঞ্জীব পলও গিয়েছিলেন সেখানে। দু’জনেই মঞ্চ থেকে রাজ্যে লগ্নি নিয়ে ইতিবাচক কথা বলেন। সিঙ্গুর দিবসের পরদিনই টাটাদের সংস্থা মুখ্যমন্ত্রীর সামনে মউ-ও সই করেছে। এ সবই ইঙ্গিতবাহী।’’
গোয়ালতোড়ের যে জমি ঘিরে রাজ্যের শিল্প ক্ষেত্রে নতুন আশা দেখা দিয়েছে, সেখানে কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পর থেকেই নানা প্রকল্প রূপায়ণের কথা শোনা যাচ্ছে। মমতার সরকার প্রথমে এখানকার বীজ খামারের জমিতে কেন্দ্রীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। পরে কৃষি খামার, পর্যটন কেন্দ্র গড়ারও কথা হয়। কিন্তু কোনওটাই দিনের আলো দেখেনি।
গোয়ালতোড়ের দুর্গাবাঁধের লোকজনের শিল্প-স্বপ্নও বেশ পুরনো। ২০১৩ সালের অগস্টে এই এলাকায় সরকারি বীজ খামার পরিদর্শন করতে এসেছিলেন তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সে দিন তাঁর মুখে শোনা গিয়েছিল, এলাকায় শিল্পতালুক গড়ার কথা, স্থানীয়দের কাজ পাওয়ার কথা। আশায় বুক বেঁধেছিলেন ওই এলাকার মানুষ। তারপর সব চুপচাপ। মাঝে শুধু ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার এক শিল্প সংস্থার প্রতিনিধিরা এলাকাটি দেখতে এসেছিলেন। তারপর আর কৃষি দফতরেরঅধীন এই বীজ খামারের জমিতে শিল্প গড়ার কোনও
উদ্যোগ চোখে পড়েনি। তাতে হতাশা বেড়েছিল দুর্গাবাঁধে। তবে বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে গোয়ালতোড়ের বাসিন্দারা ফের আশায় বুক বাঁধছেন।
গোয়ালতোড়ের জিরাপাড়া পঞ্চায়েতের অধীন দুর্গাবাঁধে এই বীজ খামারটি গড়ে ওঠে ১৯৬৫ সালে। এ দিন সকাল থেকেই এখানে ব্লক অফিসের প্রশাসনিক আধিকারিকদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। যা দেখে স্থানীয় গাছউপড়া গ্রামের যুবক সঞ্জয় কারক, তেঁতুলডাঙার কৌশিক মণ্ডলরা বলছিলেন, “বহুদিন ধরে শুনছি, এখানে শিল্প হবে। এ বার মনে হচ্ছে তা সত্যিই হবে। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী নিজে ঘোষণা করেছেন।” বীজ খামারের অস্থায়ী শ্রমিক মায়া মুর্মু, দুলাল কারকরাও বলছেন,
“শিল্প হলে এলাকার বেকার ছেলেরা অন্তত দু’বেলা পেট ভরে খেতে পাবে।’’ তাঁদের অবশ্য দাবি, ‘‘খামারটা বাঁচিয়ে কারখানা গড়া হোক। না হলে আমরা যাব কোথায়?’’ ওই খামারের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক সিরাজ মজুমদারেরও মত, “চাষের জন্য কিছুটা জমি রেখে শিল্প
হতেই পারে।”
তবে গোটা এলাকা কতদিনে শিল্প-বান্ধব হয়ে উঠবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে স্থানীয়দের। কারণ, তিন বছর আগে খামার পরিদর্শনের সময় তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী পার্থবাবু জেলা প্রশাসনের আধিকারিকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, খামারের জমির চারপাশে পাঁচিল দিতে হবে। সেই কাজ শুরুই হয়নি। গোয়ালতোড় শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার রাস্তা চওড়া করার কথাও নির্দেশেই আটকে রয়েছে। এলাকায় রয়েছে জলের সমস্যাও। কাছেই কংসাবতী ক্যানাল। তবে তাতে জল থাকে শুধু বর্ষায়। যদিও ১০ কিলোমিটার দূরে জগারডাঙায় শিলাবতী নদী থেকে প্রয়োজনে পাইপ লাইনে জল আনা সম্ভব বলে জেলা প্রশাসনের আধিকারিকেরা জানিয়েছেন। জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদেরও আশ্বাস, “রাস্তা, বিদ্যুৎ, জল—কোনও কিছুরই সমস্যা হবে না।”
• কলকাতা থেকে ১৮৫ কিলোমিটার এবং চন্দ্রকোনা রোড রেলস্টেশন ও জাতীয় সড়ক থেকে ২৯ কিলোমিটার
• গোয়ালতোড় থেকে হুমগড়ের দিকে প্রায় ৬০ ফুট চও়়ড়া (২২ ফুট পিচ রাস্তা ও দু’পাশের মোরাম-সহ) ১২ কিলোমিটার রাস্তা ধরে গেলে জিরাপাড়া মোড়। সেখানে থেকে বাঁ দিকে আরও আড়াই কিলোমিটার মোরাম রাস্তা গেলে পড়বে বীজ খামার
• খামার থেকে১০ কিলোমিটার দূরে জগারডাঙায় শিলাবতী নদী
• মোট জমি ৯৫০.১৬ একর। চাষ হয় ৩১০ একরে। মূলত পাট বীজ তৈরি হয়। সঙ্গে ধান, আলু, ডালশস্যও চাষ হয়।
• ৩০০ একরে কাজুবাগান, ২০ একরে আমবাগান, ২০ একরে নিমবাগান। ভ্যারেন্ডা চাষ হয় ৩০ একরে। প্রশাসনিক ভবন ১৫ একর জমির উপর। পুকুর রয়েছে ১০ একর জমিতে। রাস্তা ৩০ একরে। পতিত জমি ১৮৫.১৬ একর।