রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। ফাইল চিত্র
রাজ্যপালের ডাকা প্রশাসনিক বৈঠক এড়িয়ে গেলেন মন্ত্রী, আমলা, পুলিশকর্তারা। বিরোধী দলগুলির জনপ্রতিনিধিরা হাজির হলেও শাসক শিবির প্রায় পুরোপুরি অনুপস্থিত থাকল শিলিগুড়ির এই বৈঠকে। আর তা নিয়ে ক্ষোভও গোপন রাখলেন না রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। কটাক্ষের সুরে তাঁর মন্তব্য, ‘‘সবাই হয়তো একসঙ্গে ব্যস্ত।’’ তবে ভবিষ্যতেও তিনি এই রকম বৈঠক করবেন এবং তখন সকলে সেখানে যোগ দেবেন বলে এ দিন আশা প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল। রাজ্যের পর্যটন মন্ত্রী তথা ওই জেলারই তৃণমূল নেতা গৌতম দেব অবশ্য জানিয়েছেন, রাজ্যপাল তাঁকে বৈঠকে আমন্ত্রণই জানাননি।
শিলিগুড়িতে রাজ্যপালের ডাকা বৈঠকে এ দিন শিলিগুড়ির মেয়র তথা সিপিএম বিধায়ক অশোক ভট্টাচার্য হাজির হয়েছিলেন। হাজির হয়েছিলেন দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তা বা মাটিগাড়া-নকশালবাড়ির বিধায়ক তথা প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম কার্যনির্বাহী সভাপতি শঙ্কর মালাকারও। কিন্তু রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য পুলিশের শীর্ষকর্তারা, দার্জিলিঙের জেলাশাসক-সহ সরকারি পদাধিকারীরা যে বৈঠকে হাজির হননি, সে কথা বৈঠকের পরে হওয়া সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যপাল নিজেই উল্লেখ করেন। শাসক দলের কোনও প্রতিনিধিকেও তাঁর ডাকা বৈঠকে দেখা না যাওয়া নিয়ে রাজ্যপাল এ দিন আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় বলেন, ‘‘হয়তো সব প্রশাসনিক কর্তারা ব্যস্ত ছিলেন, ভবিষ্যতে তাঁরা হয়তো দেখা করবেন, রাজভবনের দরজা তাঁদের জন্য খোলা।’’ দার্জিলিং জেলায় তাঁর ডাকা প্রশাসনিক বৈঠকে শাসক দল এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদাধিকারীরা অনুপস্থিত থাকায় তিনি যে দমে যাননি, তা-ও কিন্তু ধনখড় এ দিন বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি জনসংযোগ রক্ষা করতে প্রতিটি জেলায় যাব।’’ তাঁর ডাকা প্রশাসনিক বৈঠকের নেপথ্যে কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধি নেই— এই বার্তা এ দিন খুব স্পষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করেন ধনখড়। তিনি বলেন, ‘‘আমি একজন কপিবুক রাজ্যপাল। কোনও রং দেখে কাউকে বিচার করি না। রাজভবন সবার জন্যে খোলা। আমন্ত্রণ পেলে আমি ভবিষ্যতেও শিলিগুড়ি আসব।’’
আরও পড়ুন:তেলই পুড়ছে সিবিআইয়ের, সাঁতরাগাছি থেকে মেচেদা ঘুরে রাজীব সেই অধরা
রাজ্যপালের মন্তব্য সম্পর্কে আমলা বা পুলিশকর্তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ভাবেই কোনও পাল্টা প্রতিক্রিয়া এ দিন পাওয়া যায়নি। তবে পর্যটন মন্ত্রী তথা ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির তৃণমূল বিধায়ক গৌতম দেব প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। তাঁর পদকে সম্মান করি। কিন্তু তাঁর কথা আমাকে মর্মাহত করছে।’’ কেন মর্মাহত করছে, সেই ব্যাখ্যাও গৌতম দেব দিয়েছেন। আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, ‘‘একটি বণিকসভার অনুষ্ঠান ছিল। সেই অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন, আমি বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলাম। কিন্তু আমি যে ব্যস্ত থাকব, যেতে পারব না, সে কথা ওই বণিকসভাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। এটা নিয়ে রাজ্যপালের কী বলার থাকতে পারে আমি জানি না।’’ গৌতম আরও বলেন, ‘‘রাজ্যপাল নিজেও এ দিন একটি বৈঠক করেছেন বলে শুনেছি। কিন্তু সেই বৈঠকের কোনও আমন্ত্রণ আমি পাইনি। পেলে যেতাম কি না, সেটা পরের কথা। কিন্তু আমন্ত্রণই যে পাইনি, সেটা জেনে যদি রাজ্যপাল কথা বলতেন, তা হলে ভাল লাগত।’’
সাংবাদিকরা এদিন রাজ্যপালের কাছে যাদবপুর-কাণ্ড প্রসঙ্গে জানতে চান। প্রশ্ন করা হয়, সে দিন কি মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে যাদবপুরে যেতে বারণ করেছিলেন? জবাবে রাজ্যপাল পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে ওই দিন চারবার কথা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি কি জনতার সামনে এমন বিবৃতি দিয়েছেন?’’ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ‘শ্রদ্ধার সম্পর্ক অটুট রয়েছে’ বলেও এ দিন রাজ্যপাল মন্তব্য করেন। যাদবপুর কাণ্ডে নিজের ভূমিকার কথা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যাও করেন তিনি। তাঁর দাবি, তিনি যাদবপুরে সম্মান পেয়েছেন। সে দিন কোনও হঠকারি সিদ্ধান্ত তিনি নেননি। উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলেই সেখানে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে উদ্ধার করতে। শুধু উপাচার্য নয়, এই বিষয়ে তিনি ছাত্রদের সঙ্গেও কথা বলেন। তাঁর মতে, রাজভবন বা রাজনৈতিক শক্তি নয়, ভবিষ্যতেও আচার্য এবং উপাচার্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবেন।
আরও পড়ুন: ঊর্মিমালাকে কদর্য আক্রমণ সোশ্যাল মিডিয়ায়, সরব বিদ্বজ্জনেরাও
যাদবপুর কাণ্ডের পর পাঁচ দিন পেরিয়ে গিয়েছে। এই ঘটনায় রাজ্যে এই মুহূর্তে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনার আবহ তৈরি হয়েছে। সোমবার গোলপার্ক থেকে সেলিমপুর পর্যন্ত মিছিল করে এবিভিপি। এই অবস্থায় আস্থা হারাচ্ছেন না রাজ্যপাল। তাঁর বিশ্বাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধান করা সম্ভব। রাজ্যপাল এ দিন বলেন, ‘‘বাংলায় সব রয়েছে। এত প্রতিভা, এত গুণী মানুষ রয়েছেন, বাংলার শীর্ষে যাওয়া উচিত। আমি আমার মেয়াদকালেই বাংলার শীর্ষ আরোহণ দেখে যেতে চাই।’’
তবে এনআরসি প্রসঙ্গে কোনও অবস্থান এ দিন জানাতে চাননি রাজ্যপাল। রাজ্যে এনআরসি জরুরি কি না, সে প্রশ্ন সযত্নে এড়িয়ে যান তিনি। আইনসভা তাঁর কাছে কিছু পাঠালে তিনি শুধু দেখেন সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে কি না, অন্য কিছু তাঁর দেখার কথা নয়— ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে এনআরসি প্রসঙ্গে এ কথাই বলেন রাজ্যপাল। নিজের সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য তিনি ‘সক্রিয়’ রাজ্যপাল, কিন্তু ‘অতিসক্রিয়’ নন। সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার কারণেই এক্তিয়ার বহির্ভূত বিষয়ে তিনি কথা বলতে চান না বলে রাজ্যপাল এ দিন মন্তব্য করেন।