জগদীপ ধনখড়ের প্রতিক্রিয়ার পাল্টা বিবৃতি দিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়।—ফাইল চিত্র।
রাজ্য প্রশাসন এবং পুলিশের সমালোচনা করে ফের কড়া বিবৃতি রাজ্যপালের। কিছু ক্ষণের মধ্যেই পাল্টা বিবৃতি দিয়ে ‘সীমার’ মধ্যে থাকার কথা রাজ্যপালকে মনে করিয়ে দিলেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ফলে জিয়াগঞ্জে স্কুল শিক্ষক বন্ধুপ্রকাশ পালের সপরিবার হত্যাকে কেন্দ্র করে অনেকখানি চড়ে গেল রাজনৈতিক উত্তাপ।
মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে দশমীর দুপুরে খুন হন প্রাথমিক শিক্ষক বন্ধুপ্রকাশ পাল। খুন হন তাঁর অন্তঃসত্বা স্ত্রী এবং বছর পাঁচেকের ছেলেও। নিজেদের বাড়িতেই খুন হন তাঁরা। হাঁসুয়ার এলোপাথাড়ি কোপে তাঁদের হত্যা করা হয় বলে প্রাথমিক তদন্তের পরে জানায় পুলিশ। কালো গেঞ্জি ও প্যান্ট পরা এক আততায়ীকে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পাঁচিল টপকে পালিয়ে যেতেও দেখেছিলেন এক ব্যক্তি, খবর স্থানীয় সূত্রের। তবে খুনের কারণ সম্পর্কে পুলিশ এখনও নিশ্চিত নয়। ফলে কেউ গ্রেফতারও হয়নি।
পারিবারিক বিবাদ, সম্পত্তি সংক্রান্ত জটিলতা, সম্পর্কের টানাপড়েন— এমন নানা তত্ত্ব উঠে এসেছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু বন্ধুপ্রকাশ পাল ছিলেন আরএসএস সদস্য। ফলে গোটা পরিবারের এই হত্যা নিয়ে হইচই শুরু করেছে বিজেপি। দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে রাজনৈতিক উত্তাপ।
আরও পড়ুন: অযোধ্যার বিতর্কিত জমি হিন্দুদের দিতে আপত্তি নেই মুসলিম সমাজের বিশিষ্টজনদের
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের প্রতিক্রিয়া সামনে এসেছে। রাজভবনের তরফে একটি কঠোর বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে এ দিন। তাতে রাজ্য প্রশাসনের স্পষ্ট সমালোচনা করা হয়েছে। বিবৃতিতে লেখা হয়েছে, ‘‘রাজ্যপালের মতে, এই ঘটনার তীব্রতা এমনই যে, তাতে বিবেক কেঁপে উঠেছে। এই ঘটনা অসহিষ্ণুতা এবং ভয়ঙ্কর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রতিফলন।’’ গোটা পরিবারের হত্যার ঘটনা সামনে আসার পরে পর্যাপ্ত সময় পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পুলিশ বা রাজ্যের পদাধিকারীরা উদ্বেগ প্রকাশ না করায় রাজ্যপাল অসন্তুষ্ট— লেখা হয়েছে রাজভবনের বিবৃতিতে।
রাজভবন আরও জানিয়েছে যে, রাজ্যপাল ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে নিজের উদ্বেগের কথা রাজ্যের মুখ্যসচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে জানিয়েছেন। তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গেও রাজ্যপাল কথা বলেছেন এবং কোনও কিছুর দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে স্বচ্ছ তদন্ত করতে বলেছেন— লেখা হয়েছে রাজভবনের বিবৃতিতে।
আরও পড়ুন: সপরিবার শিক্ষক খুনে এখনও কুয়াশা
জিয়াগঞ্জের এই ঘটনায় বিজেপির তরফ থেকেও তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে এ দিন। বৃহস্পতিবার দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিংহ বলেছেন, ‘‘একই পরিবারের তিন জনকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হল। তাঁরা সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক। সেই পরিবারের উপরেই হামলা হয়েছে। এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমবাংলায় আইনশৃঙ্খলা বলতে কিচ্ছু নেই। একটা জঙ্গলের রাজত্ব চলছে পশ্চিমবাংলায়। খুনির কোনও ভয় নেই এবং খুনি কত হিংসাত্মক যে, ছোট বাচ্চাটিকে পর্যন্ত ছাড়েনি।’’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই আক্রমণ করেছেন রাহুল। তিনি বলেছেন, ‘‘এই যে অবস্থা চলছে, এর জন্য রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন দায়ী। এর দায় স্বীকার করে মুখ্যমন্ত্রী, যিনি পুলিশমন্ত্রীও, তাঁর অবিলম্বে পদত্যাগ দাবি করছি। কারণ এই ঘটনার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আর পুলিশমন্ত্রী পদে থাকার কোনও অধিকার নেই।’’
বিজেপির এই আক্রমণের কোনও জবাব তৃণমূল বা রাজ্য সরকার এখনও দেয়নি। কিন্তু রাজভবনের বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই পাল্টা কঠোর প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূল মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর কথায়, ‘‘তৃণমূলের পক্ষ থেকে আমরা লক্ষ্য রাখছি, রাজ্যের রাজ্যপাল প্রায় প্রতিদিনই সাংবিধানিক পদে থেকে রাজনৈতিক মন্তব্য করে নিজেই সাংবিধানিক সীমারেখা লঙ্ঘন করছেন।’’ কোনও রাখঢাক না করেই রাজ্যপালের উদ্দেশ্য নিয়ে এ দিন প্রশ্ন তুলেছেন পার্থ। তিনি বলেছেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অভিসন্ধিমূলক। যখন এই রাজ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম শারদীয় উৎসব নির্বিঘ্নে পালিত হয়, তখন রাজ্যপাল সেটা দেখতেই পান না।’’ বিভিন্ন বিজেপিশাসিত রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থা এবং সে দিক থেকে নজর ঘোরাতেই রাজ্যপাল এই ধরনের মন্তব্য করছেন বলে পার্থ এ দিন অভিযোগ করেছেন।
রাজভবনের প্রকাশ করা বিবৃতির সুর যেমন কড়া, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আক্রমণও এ দিন ততটাই চড়া শুনিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘আমরা বলতে চাই যে, রাজ্যপাল যেন নিজেকে সংযত রাখেন, নিজের সীমা লঙ্ঘন না করেন। মুর্শিদাবাদের একটি পারিবারিক ঘটনা নিয়ে এত অপপ্রচার কেন? যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য রাজ্যপালকে মঞ্চে নামানো হয়েছে।’’
বিজেপি এ দিন আক্রমণ করেছে বাংলার সুশীল সমাজের একাংশকেও। কটাক্ষের সুরে রাহুল সিংহের প্রশ্ন, ‘‘কোথায় গেলেন মানবাধিকারের কথা বলা লোকেরা? কোথায় গেলেন বাক্স্বাধীনতার কথা বলা লোকেরা? এখন তাঁরা কেন নীরব?’’ রাহুলের কথায়, ‘‘কোনও রাজ্যে একটা খুন হলেই যাঁরা আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে রাস্তায় নেমে চিৎকার শুরু করেন, সেই বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছে কেন? আজ বুদ্ধিজীবীদের মুখে তালা লেগে গিয়েছে কেন?’’