কাদের-অস্বস্তি ক্রমশ বাড়ছে রাজ্যের শাসক দলের অন্দরে।
এক দিকে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত কাদের খান ও তার বান্ধবী তথা টালিগঞ্জের এক নায়িকার সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ স্তরের নেতা-মন্ত্রী যোগের বিষয়টি ফের সামনে এসেছে। অন্য দিকে কাদের-অন্তর্ধানের পিছনে শাসক দলের প্রভাবশালী অংশের যোগের দিকে ইঙ্গিত করে বিশেষ সরকারি আইনজীবী সর্বাণী রায় যে ভাবে ‘সরকার চাইলে এখনও তাকে ধরতে পারে’ বলেছেন, তাতে প্রশাসনের পাশাপাশি বিড়ম্বনা বেড়েছে দলেরও। এই অবস্থায় বিরোধীরা যখন সরকারকে প্যাঁচে ফেলতে সক্রিয়, তখন বসে নেই শাসক দলও। কাদের নিয়ে নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে তৃণমূল। একই সঙ্গে বিরোধীদের আক্রমণ ঠেকাতে তারা এখন পাল্টা নিশানা করছে পুলিশকে। যে পুলিশ আবার দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই অধীনে!
তৃণমূলের একাংশ বলছেন, পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের গোড়াতেই কাদেরের সঙ্গে টালিগঞ্জের এক নায়িকার সম্পর্কের কথা উঠে এসেছিল। তার পরেও যে ভাবে দলের নানা অনুষ্ঠান ও কাজকর্মে ওই অভিনেত্রীকে কাজে লাগানো হয়েছে, তা উচিত হয়নি। পাশাপাশি কাদের খানকে পুলিশ এখনও ধরতে পারেনি। তার দায়ও বইতে হচ্ছে দলকে। কিন্তু ঘটনা হল, কাদেরকে পুলিশের না ধরার জন্যও তো তৃণমূল তথা সরকারের একাংশের দিকেই আঙুল তোলা হচ্ছে। রবিবার তৃণমূলের এক নেতা বলেন, ‘‘কাদের তো দাউদ ইব্রাহিম নয়! পুলিশ তাকে ধরতে পারছে না কেন? পুলিশ যাতে তৎপর হয়, সে জন্য দলের তরফে সরকারের কাছে দাবি জানানো প্রয়োজন।’’ যা শুনে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘পুলিশ তো বসে নেই! কয়েক জনকে ধরেছে। কাদেরকেও ধরবে!’’
কাদেরকে ধরার ব্যাপারে পার্থবাবুর মন্তব্যে কিছুটা আশার আলো দেখছেন লালবাজারের একটা অংশ। এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, ‘‘পুলিশ ও শাসক দলের একাংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদেই জাল ছিঁড়ে পালিয়েছিল কাদের। এখন উপরওয়ালাদের যা মতিগতি দেখছি, তাতে কাদের বিদেশে থাকলেও হয়তো ধরে আনা যাবে।’’ লালবাজারের খবর, পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের পর কাদের ফেরার হলেও তার গতিবিধির উপরে নজরদারির একটা ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে ধৃত রুমান খান, নাসির খান এবং সুমিত বজাজের সাজা ঘোষণা হতেই কাদেরের উপরে নতুন করে নজরদারি চালানোর ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছে কলকাতা পুলিশ।
লালবাজারের খবর, ঘটনার পর মুম্বইয়ের একটি হোটেলে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ টালিগঞ্জের ওই নায়িকাকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল কাদের। সেখান থেকে পালিয়ে বিহার হয়ে নেপাল এবং বাংলাদেশে ঘাঁটি গেড়েছিল সে। ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে কাদের পশ্চিম এশিয়ার কয়েকটি দেশ এবং উত্তর ভারতেও ঘুরেছে বলে গোয়েন্দা সূত্রের দাবি। পুলিশের একাংশ বলছেন, উত্তরপ্রদেশে কাদেরের আত্মীয় রয়েছে। সেখানে সে ঘাঁটি গেড়েছে। গোয়েন্দাদের একাংশের আবার দাবি, কাদের পশ্চিম এশিয়ার একটি দেশে রয়েছে। সে ব্যাপারে কিছু প্রমাণও মিলেছে।
কাদের-প্রশ্নে তৃণমূল যে বেশ প্যাঁচে পড়েছে, তা বুঝে তাদের আরও চেপে ধরতে মরিয়া বিরোধীরা। শনিবার থেকেই এ নিয়ে পথে নেমেছে বামেরা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী রবিবার বলেন, ‘‘পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের পরেই মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী বলে দিলেন ‘সাজানো ঘটনা’। তার পরে পুলিশ তো বুঝে গিয়েছে, তাদের কত দূর পর্যন্ত তদন্তের কাজ করতে হবে! সংসারের কর্ত্রী যে ভাবে রান্নার নির্দেশ দেন, রাঁধুনি তো সে ভাবেই রান্না করবে। সেই জন্যই কাদের এখনও অধরা!’’ আজ, সোমবার কলকাতায় যুব কংগ্রেসের বিক্ষোভ কর্মসূচি রয়েছে। সেট়া মিটলেই পার্ক স্ট্রিট নিয়ে যুব কংগ্রেসকে পথে নামার নির্দেশ দিয়েছেন অধীর।
বিরোধীরা পার্ক স্ট্রিট নিয়ে ফের পথে নামায় ক্ষুব্ধ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সুজেটের (পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের ধর্ষিতা) পরিবারের প্রতি সহানুভুতি দেখানোর চেয়ে এখানে রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতাই বেশি কাজ করছে।’’
কাদেরকে ধরার জন্য যেমন নতুন করে পুলিশের গা-ঝাড়া দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে, তেমনই কাদেরের তিন শাস্তিপ্রাপ্ত সঙ্গীর বিরুদ্ধেও ফের কোমর বেঁধে লাগছেন পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের অভিযোগকারিণী সুজেট জর্ডনের পরিবার ও বন্ধুরা। রুমান, নাসির ও সুমিতকে আদালত দশ বছরের সাজা ও ১ লক্ষ টাকা করে জরিমানা করেছে। সুজেটের আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতা এ দিন জানিয়েছেন, আজ, সোমবার তাঁরা নিম্ন আদালতের রায়ের প্রতিলিপি পাওয়ার জন্য আবেদন করবেন। সেই প্রতিলিপি হাতে এলেই মামলার আসামীদের যাবজ্জীবন সাজার আর্জি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হবেন তাঁরা। ‘‘বড়দিনের ছুটির আগেই যাতে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা যায়, সেই চেষ্টাই করছি,’’ বলেন অনির্বাণ।