কখনও পানীয় জলের পাম্প খারাপ হচ্ছে। কখনও ভেঙে পড়ছে জীর্ণ ছাদের চাঙর। মেরামতির পর্যাপ্ত টাকা নেই। কেআইটি-র ভাড়ার ফ্ল্যাটগুলি নিয়ে ফাঁপড়ে পরে সরকার প্রায় এক দশক আগেই ভাড়াটিয়াদের কাছেই এগুলো বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাতে কাজ প্রায় হয়নি বললেই চলে। ফের এগুলো বিক্রি করতে উদ্যোগী হল নগরোন্নয়ন দফতর।
প্রায় সাড়ে আট হাজার কেআইটি ফ্ল্যাট রয়েছে শহরজুড়ে। ভাড়া দিয়ে বছরে যা আয়, খরচ প্রায় তার দশ গুন। কয়েক দশক আগে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যে ফ্ল্যাটগুলি শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারদের থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া জন্য তৈরি করা হয়েছিল, বেশ কিছুকাল ধরেই সেগুলি সরকারের গলার কাঁটা হয়ে উঠছে।
বাম আমলে একবার ওই ফ্ল্যাটগুলি ভাড়াটিয়াদের মধ্যেই বিক্রি করে দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু তাতে বিশেষ কাজ হয়নি। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ ব্যাপারে সচেষ্ট হয়। তাতেও কাজ হয়েছে অতি সামান্য। ফের ভাড়াটিয়াদের কাছেই ফ্ল্যাটগুলি বিক্রি করে দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে কেএমডিএ-এর পরিচালন পর্ষদের বৈঠকে। কারণ দেনার দায়ে এমনিতেই সরকারের এখন হাঁড়ির হাল অবস্থা। তার উপরে বছরে কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ওই ফ্ল্যাটগুলির ভাড়াটিয়াদের দাবি মানতে।
২০১২-র জুলাই মাসে কেএমডিএ-এর সভায় সরকারি ভাবে প্রস্তাব উঠেছিল, ৮৪০ টাকা প্রতি বর্গফুট দরে ভাড়াটিয়াদের ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ দেওয়া হবে। আর যে সমস্ত ফ্ল্যাট বেআইনি ভাবে হস্তান্তর হয়ে গিয়েছে, সেগুলির বর্তমান মালিকদের ফ্ল্যাটের মোট দামের দ্বিগুন দাম দিতে হবে। কিন্তু কেএমডিএ-এর ওই প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন খোদ নগরোন্নয়ন মন্ত্রী। তাঁর যুক্তি, ফ্ল্যাটগুলি তৈরি হয়েছিল ৫০ বছরেরও বেশি আগে। ২০০৪ সালে সরকারের পক্ষ থেকে ৬৬ টাকা প্রতি বর্গফুট দরে ভাড়াটিয়াদের ফ্ল্যাট কিনে নিতে বলা হয়েছিল। তাতে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। সেখানে ৮৪০ টাকা বগর্ফুট দরে কে কিনবে! মন্ত্রী প্রস্তাব দেন, তার চেয়ে ৬৬ টাকা বর্গফুট দরে ফ্ল্যাটগুলি বিক্রি করে দেওয়া হোক। বৈঠকে মন্ত্রীর প্রস্তাবই শেষ পর্যন্ত অনুমোদন পায়।
এর পর ২০১২-র নভেম্বর মাসে ভাড়াবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে রাজ্যের নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “ভাড়া বাড়ানো হয়েছে এইচআইজি এবং এমআইজি-র। গরিব মানুষের স্বার্থে এলআইজি-র ভাড়া বাড়ানো হয়নি।” যদিও বিজ্ঞপ্তিতে পরিষ্কার ছিল, কেআইটি-র সব ধরনের ফ্ল্যাটেরই ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। ভাড়ার ফ্ল্যাটের বেশিরভাগটাই এলআইজি।
কত ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল? যে আবাসনের ফ্ল্যাটে আগের ভাড়া ছিল মাসিক ২৯.৫০ টাকা। তা বাড়িয়ে চার গুন, অর্থাত্ ১১৮ টাকা, সঙ্গে মাসে ৪৫০ টাকা পরিষেবা ফি ধার্য হয়েছিল। সব মিলিয়ে ওই ভাড়ার ফ্ল্যাটের মাসিক দেয় ধার্য হয় ৫৬৮ টাকা। কিন্তু আবাসিকদের আপত্তিতে জনমোহিনী পথেই হাঁটতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। এর পর বাড়তি ভাড়া আর আদায় করা সম্ভব হয়নি। ভর্তুকির বোঝা বেড়েছে।
এই অবস্থায় শহরের ২৪টি কেআইটি আবাসনের অধিকাংশেরই হাল ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। ছোটখাট দুর্ঘটনাও ঘটছে। মহাকরণ এবং কেআইটি-র সদর দফতরের হাঁটাপথে সিংহিবাগান আবাসন। সেখানকার অবস্থাও ভাল নয়। কেআইটি-র এক কর্তা অবশ্য দাবি করেন, ‘‘সিংহিবাগান এবং ক্রিস্টোফার রোড আবাসনের অধিকাংশ ফ্ল্যাট আবাসিকদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এবার রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব ওঁদের।’’ অন্য ফ্ল্যাটগুলো সম্পর্কে কেআইটি-র বক্তব্য, ‘‘পর্যাপ্ত মেরামতির পয়সা নেই। ভাড়া বাবদ পাচ্ছি বছরে ৪৪ লক্ষ টাকার মত। খরচ হচ্ছে এর প্রায় ১০ গুণ।’’
একই কারণে ভুগেছেন রাজ্যের প্রাক্তন নগরোন্নয়ন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যও। তিনি বলেন, “আমাদের আমলেও কেআইটি-র ফ্ল্যাটগুলি বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। সিংহীবাগান এবং ক্রিস্টোফার রোডের ফ্ল্যাট ছাড়া অন্য কোথাও ভাড়াটিয়ারা ফ্ল্যাট কেনার জন্য এগিয়ে আসেনি।”
রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানান, কেআইটি-র ফ্ল্যাটগুলি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আর সরকার নিজের ঘাড়ে রাখতে চায় না। এই কারণে ফ্ল্যাটগুলি ভাড়াটিয়াদের কাছেই বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।