রবীন্দ্রসদনের অনুষ্ঠানে সুগত বসু। নিজস্ব চিত্র
তিনি বরাবরই দলের ঊর্ধ্বে। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা গোঁড়ামির ধার ধারেন না। আজকের ভারতেও এই মুক্ত মনের সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষের প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম।সোমবার সন্ধ্যায় রবীন্দ্রসদনে গৌরকিশোরের শতবর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানের সূচনায় দু’জন বক্তাই এক সুরে বলে উঠলেন।
শতবর্ষ স্মারক বক্তৃতায় ইতিহাসবিদ সুগত বসু বলছিলেন, জরুরি অবস্থার সময়ে সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোরের দু’টি লেখার কথা। লেখকের প্রেসিডেন্সি জেলের বন্দিদশাতেও তা বাইরে পৌঁছেছিল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা চিঠিতে তিনি ফ্যাসিবাদের পাঠ দিয়েছিলেন। ইন্দিরা নিজেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার প্রবক্তা বলে তুলে ধরলেও গৌরকিশোর বোঝান, দলীয় নেতাই দেশ, এই অহমিকাকে নিরন্তর প্রশ্রয় দিয়ে ও-সব ভেক চলে না। সুগতের কথায়, ‘‘নেতার মহিমার সর্বগ্রাসী রূপ আজকের ভারতে আরও বেশি প্রকট। অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে।’’
‘মনুষ্যত্বের সন্ধানে’-শীর্ষক বক্তৃতায় পরিবেশকর্মী মেধা পাটকরও বলেছেন, ‘‘আজকের দিনে গৌরকিশোরকে আরও তীব্র ভাষায় চিঠি লিখতে হত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। কেন না, দেশে এখন যা চলছে তা সুপার ইমার্জেন্সি।’’ সুগত আক্ষেপ করেছেন, সুভাষচন্দ্র বসুর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসুর মতো কারও কারও কথার তোয়াক্কা করেননি এ দেশের সংবিধান প্রণেতারা। ১৯৫০ সালের শুরুতে একটি লেখায় শরৎ ঠিকই বুঝেছিলেন, এ দেশের জরুরি অবস্থা ঘোষণার আইনটি সাক্ষাৎ টাইমবোমা। ঔপনিবেশিক শাসনের কিছু আইনি উত্তরাধিকার স্বাধীন ভারত বহন করে চলেছে, এবং তা হাতিয়ার করে আজও মুক্তমনা বহু স্বরের কণ্ঠ রোধ চলছে। সুগতের কথায়, ‘‘গৌরকিশোরের সময়ে আইনের নাম ছিল ‘মেনটেন্যান্স অব ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’। এখনকার আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ় প্রিভেনশন অ্যাক্ট (ইউএপিএ)-ও একই রকম অনৈতিক। গালভরা নামের আইনে আরও বড় অন্যায়ের লক্ষ্যে আজও সংসদে সংশোধনী আনা হচ্ছে। বিনা বিচারে যাকে খুশি বছরের পর বছর জেলে আটকে রাখা চলছে।’’
মেধা বলেন, এক দিকে শাসকের ঘৃণাতন্ত্র (হেট জিহাদ) চলছে, অন্য দিকে দেশের জনসংখ্যার ১ শতাংশ অন্তত ৫৮ শতাংশ সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করছে। মানুষের জীবিকা থেকে প্রকৃতি— দু’টোই আজ সঙ্কটে।’’
ঘটনাচক্রে এ দিনটি ছিল উদ্বাস্তু দিবস। মেধা মনে করিয়েছেন, নর্মদা আন্দোলনের প্রতি ‘গৌরকিশোরদা’র সক্রিয় সংবেদনশীল সমর্থনের কথা। প্রবীণ পরিবেশকর্মী বলেন, এখন বাংলা, কেরল, ঝাড়খণ্ডের মতো অবিজেপি রাজ্যগুলিও জনবিরোধী শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে করমর্দন করতে বাধ্য হচ্ছে। মেধার কথায়, ‘‘এই দুঃসময়ে গৌরকিশোরদার মতো সাহসী সাংবাদিকতা দরকার। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় মিডিয়ার বড় অংশই হয় শাসকের তাঁবেদার নইলে নিস্ক্রিয়।’’
১৯৭৬-এর প্রজাতন্ত্র দিবসে, দেশবাসীর উদ্দেশে একটি চিঠিতে গৌরকিশোর বলেছিলেন, নিষ্ক্রিয়তাই পাপ, কেন না তা সহযোগিতাই। ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে ভাগলপুরের গণহত্যার সময়ে সত্তরোর্ধ্ব গৌরকিশোরের ভাগলপুরে সাংবাদিকতা করতে যাওয়ার মধ্যে সুগত এক ধরনের ‘গান্ধী যাত্রা’ই দেখেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বিপদের সময়ে সাহসিকতার মধ্যেই গৌরকিশোর মনুষ্যত্বের সন্ধান পেয়েছেন।’’ ২০০০ সালে গৌরকিশোরের প্রয়াণের পর থেকেই তাঁর পরিবারের তরফে নানা অনুষ্ঠানে প্রয়াত সাংবাদিক-সাহিত্যিকের সারা জীবনের ভাবনাগুলি নিয়ে চর্চা করা হয়। এ দিনও শতবর্ষ উদযাপন কমিটির উদ্যোগে গৌরকিশোরের সূত্র ধরেই উঠে এসেছে সমকালের ভারতের কথা। ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। শৈবাল মিত্রের পরিচালনায় গৌরকিশোরকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও এ দিন দেখানো হয়েছে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।