ধর্মতলায় এই মিছিল থেকেই ওঠে ‘গোলি মারো গদ্দারোঁ কো’ স্লোগান। —নিজস্ব চিত্র।
দিল্লিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিয়েছিলেন বিজেপি সমর্থকেরা। এ বার কলকাতার রাস্তাতেও শোনা গেল— ‘‘দেশ কে গদ্দারোঁ কো, গোলি মারো সালোঁ কো!’’ এর প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে তৃণমূল, বাম কংগ্রেস। বিশিষ্ট মহলের অনেকেও এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে এতে অন্যায়ের কিছু দেখছেন না রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ।এতে তাঁর কোনও বিরোধিতা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সফরের বিরুদ্ধে চৌরঙ্গির রাস্তায় প্রতিবাদে নেমেছিলেন এক দল তরুণ-তরুণী। শহিদ মিনার ময়দানে শাহের সভার দিকে যাওয়ার পথে তাঁদের কাছে এসে ওই স্লোগান দিতে শোনা গেল বিজেপি সমর্থকদের। পুলিশের সামনেই রবিবার দুপুরে ওই ঘটনার পরে বিজেপি সমর্থকেরা সভায় যোগ দিতে চলে যান। যার জেরে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বাম ও কংগ্রেস নেতারা।
ঘটনা নজরে আসার পরেই অবশ্য নবান্নের শীর্ষ মহল থেকে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়, অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। যাঁরা স্লোগান দিয়েছেন, তাঁরা এই শহরেরই লোক নাকি বাইরে থেকে আসা— সবই দ্রুত বার করতে বলা হয় পুলিশকে। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘‘মনে রাখতে হবে, এটা দিল্লি নয়। এটা কলকাতা!’’
রাতে পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, ওই ঘটনায় নিউ মার্কেট থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৫৩এ, ৫০৫, ৫০৬ এবং ৩৪ ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। দেখা হচ্ছে সিসিটিভি ফুটেজও। হুমকি প্রদর্শন, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শক্রতা সৃষ্টির চেষ্টা, গোষ্ঠী সংঘর্ষের প্ররোচনা, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে।
ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিং দিয়ে এ দিন দুপুরে বিজেপির অনেক ছোট ছোট মিছিল যাচ্ছিল শহিদ মিনারের দিকে। সেই সময়েই গ্র্যান্ড হোটেলের পাশের গলিতে বসে কয়েক জন পড়ুয়া সিএএ-বিরোধী স্লোগান দিচ্ছিলেন। নিউ মার্কেটের দিক থেকে ধর্মতলার দিকে যাওয়া বিজেপির একটি মিছিলের নজর পড়ে ওই পড়ুয়াদের দিকে। পড়ুয়াদের ‘গো ব্যাক অমিত শাহ’, ‘আজাদি’ ইত্যাদি স্লোগানও বিজেপি কর্মীরা শুনতে পান। আচমকা মিছিল থেকে কয়েক জনকে রাস্তা পেরিয়ে পডুয়াদের দিকে এগোতে দেখা যায়। দু’পাশ থেকে দু’দলের মধ্যে তখন পরস্পর-বিরোধী স্লোগান চলছে। বিজেপি সমর্থক এবং সিএএ-বিরোধিতাকারীদের মধ্যে গোলমাল যাতে আর বড় আকার না নেয়, তা সামলাতে বিশাল পুলিশ বাহিনী সেখানে পৌঁছে যায়। ঘটনাস্থলে পৌঁছন যুগ্ম-কমিশনার (অপরাধ) মুরলীধর শর্মা, অতিরিক্ত কমিশনার ডি পি সিংহ-সহ পুলিশের আধিকারিকেরা। দু’পক্ষকে সরিয়ে দেন তাঁরা। পড়ুয়ারা গলির মুখেই বসে পড়েন। পুলিশ তখন কয়েকটি খালি বাস দাঁড় করিয়ে দেয় গলির মুখে। যাতে গলিতে কারা রয়েছেন, তা রাস্তা থেকে দেখা না যায়।
দু’পক্ষকে সরিয়ে দিতেই বিজেপি-র মিছিল থেকে স্লোগান ওঠে, ‘‘দেশ কে গদ্দারোঁ কো, গোলি মারো সালোঁকো।’’ মেট্রোর ৬ নম্বর গেটের ভিতর থেকে কয়েক জন বেরিয়ে পকেট থেকে বিজেপি-র পতাকা বার করে ওই গলির দিকে যেতে চেষ্টা করেন। তাঁদের বলতে শোনা যায়, ‘‘কিসকো চাহিয়ে আজাদি? ফাড় দেঙ্গে আজাদি’র মতো স্লোগান। আর তার সঙ্গেই ‘গোলি মারো’ স্লোগান। বিজেপির ওই সমর্থকদের সরিয়ে দেয় পুলিশ। মেট্রো সিনেমার দিক থেকে ডোরিনা ক্রসিংমুখী বিজেপি সমর্থকদের মুখেও শোনা গিয়েছে ‘গোলি মারো’ স্লোগান।
রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘বাংলায় গুলি করার স্লোগান দিয়ে মানুষের মন জয় করা যাবে না। এখানে মানুষকে জয় করতে হবে ভালবাসা দিয়ে। ওদের গুলির যা শক্তি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানুষকে ভালবাসার শক্তি তার চেয়ে অনেক বেশি।’’ স্লোগানদাতাদের অবিলন্বে গ্রেফতারির দাবি করে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের প্রশ্ন, ‘‘অমিত শাহের সাঙ্গপাঙ্গদেরও এত ভয় কেন? কেন এক জনকেও ধরা গেল না? যত বাধা শুধু শাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীদের!’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রেরও মন্তব্য, ‘‘বিজেপির সংস্কৃতি এটাই। কিন্তু পুলিশ ওই স্লোগানের পরেও কেন বিজেপি সমর্থকদের যেতে দিল, সেটাই সব চেয়ে বড় রহস্য!’’
এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, ‘‘এই দলটার আচার-আচরণ সব কিছুই অগণতান্ত্রিক। পুরোপুরি নিজের খুশিমতো ফাসিস্ত কায়দায় চলছে। এদের বিষয়ে আর কিছু বলার নেই।’’
লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেনস ‘‘এমন স্লোগান শাস্তিযোগ্য অপরাধ।এই দলটা গণতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা কিছুরই তোয়াক্কা করে না। আমরা কি চরম নৈরাজ্যের দিকে এগোচ্ছি?’’
তবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ প্রত্যাশিত ভাবেই ‘গোলি মারো’ স্লোগানের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কারা কলকাতায় ‘গোলি মারো’ স্লোগান দিয়েছেন, আমি জানি না। তবে আমার এতে কোনও বিরোধিতা নেই। আমিই তো বলেছিলাম, দেশের সম্পত্তি যারা নষ্ট করছে, তাদের গুলি করা উচিত। তবে কেউ ওই স্লোগান দিয়ে থাকলে তাঁদের ভাষাটা যেন ভদ্র হয়।’’ বিজেপি সাংসদ সুভাষ সরকারের আবার অভিযোগ, বিজেপির মিছিলে লোক ঢুকিয়ে বাম ও কংগ্রেস এই কাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে!