সান্তিয়াগো মার্টিন
টাকা-মাটি নয়। টাকা-মার্টিন! ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন নয়। ফুটপাথ থেকে রাজপ্রাসাদে উঠে আসার বাস্তব!!
হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে সান্তিয়াগো মার্টিন কাজের খোঁজে পাড়ি দিয়েছিলেন মায়ানমারে। ১৯৮৮ সালে দেশে ফিরে শুরু করেন দু’সংখ্যার লটারির ব্যবসা। সেই ব্যবসার বহর বাড়তে বাড়়তে ছুঁয়ে ফেলেছে সাত হাজার কোটি টাকার ঘর! এবং সেই ব্যবসা ঘিরেই বারবার অভিযোগ উঠেছে মার্টিনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, ক্ষমতার অলিন্দে মসৃণ যাতায়াতের সুবাদেই বারংবার জাল কেটে বেরিয়ে গিয়েছেন তিনি।
পুলিশের খবর, মার্টিনের বিরুদ্ধে কেরলে লটারি জালিয়াতির ৩২টি অভিযোগ রয়েছে। সিবিআইয়ের সাতটি চার্জশিটে নাম জড়িয়েছে তাঁর। সিকিম সরকারের সঙ্গে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার কলকাতায় টাকা বোঝাই ব্যাগ-বস্তা উদ্ধার করতে গিয়ে ফের উঠে এসেছে এই মার্টিনের নামই।
অভিযোগ সম্পর্কে কী বলছেন মার্টিন? সন্ধ্যায় কলকাতা থেকে মার্টিনের মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি ফোন তোলেননি। এসএমএস করা সত্ত্বেও তার জবাব মেলেনি।
পুলিশ জানাচ্ছে, তামিলনাড়ুর একাংশে জুয়া খেলার মারাত্মক চল রয়েছে। সেই নেশাকে হাতিয়ার করেই কোয়ম্বত্তূরে দু’সংখ্যার লটারি চালু করেন মার্টিন। পরে নামেন অনলাইন লটারির ব্যবসায়। ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে তাঁর। আমলা, পুলিশকর্তাদের ধরে যাতায়াত বাড়ে ক্ষমতার অলিন্দে। ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে কেরল, কর্নাটক, মেঘালয়, অরুণাচল, পঞ্জাব এবং মহারাষ্ট্রেও।
পড়ুন: ব্যাগে-বস্তায় কুবেরের খাজানা, সন্ধান মিলল কোটি কোটি টাকার
২০০৭ সালে কর্নাটকে লটারি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তার পরেই অনলাইন লটারির হাত ধরে সেখানে ব্যবসা বাড়াতে শুরু করেন মার্টিন। সিবিআই জানায়, বেআইনি ব্যবসা নিরুপদ্রবে চালাতে দামি ঘড়ি, মদের বোতল নিয়ে সরকারি অফিসারদের ঘরে যাতায়াত করতে দেখা যেত কর্নাটকে মার্টিনের ডানহাত পারি রাজনকে। উপহার বা মদে রাজি না-হলে কোনও কোনও অফিসারকে বিলাসবহুল রিসর্টে ছুটি কাটানোর মওকা দিতেন তাঁরা। দুই পুলিশকর্তার নামও জড়িয়ে যায় এই কেলেঙ্কারিতে। রাজনকে ধরতে গিয়ে এক পুলিশকর্তার হুমকির মুখে পড়েন কর্নাটক পুলিশের এক ইনস্পেক্টর।
তামিলনাড়ুতে, তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে মার্টিনের শিকড় কত গভীরে, তার উদাহরণ হিসেবে উঠে আসছে তাঁর সিনেমা প্রযোজনার কথা। ২০১১-য় ২০ কোটি টাকায় ‘ইলাইগনান’ নামে একটি ছবি প্রযোজনা করেন মার্টিন। ছবিটির গল্পকারের নাম? এম করুণানিধি। লোকে বলে, ডিএমকে-র সঙ্গে মাখামাখি কিছুটা কাল হয়েছিল মার্টিনের। ২০১১ সালে জয়ললিতার সরকার তামিলনাড়ুর মসনদে বসেই যাঁদের জেলে পুরেছিল, মার্টিন তাঁদের অন্যতম। প্রাথমিক ভাবে জমি দখলের পাশাপাশি গুন্ডা দমন আইনে অভিযোগ দায়ের করলেও চেন্নাই পুলিশ পরে বেআইনি লটারি ব্যবসা ও প্রতারণার মামলা রুজু করে তাঁর বিরুদ্ধে। মাদ্রাজ হাইকোর্ট তাঁকে জামিন দেয়। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, কেরলের বাম নেতাদের একাংশের সঙ্গেও মার্টিনের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ ওঠায় তদন্ত শুরু করেছিল কেরলের তৎকালীন বাম সরকার।
রাজনীতির পাকা দাবাড়ু মার্টিন জেল থেকে বেরিয়ে ডিএমকে থেকে সরে আসেন। তাঁর স্ত্রী পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন, দু’জন লটারি এজেন্ট ফাঁসিয়ে দিয়েছেন মার্টিনকে। ওই দু’জনের এক জন করুণানিধির পরিবারের সদস্য। দুর্নীতি রোধ ও সমাজবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আন্দোলনের স্লোগান দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল ‘ইন্দিয়া জননায়ক কাচি’র প্রথম সারিতে রয়েছেন মার্টিনের স্ত্রী লিমা। ২০১৪ সালে ওই দল যোগ দিয়েছে এনডিএ-তে। মার্টিনের ছেলে চার্লস জোসে মার্টিন বিজেপির সদস্যপদ পেয়ে গিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, এই যাঁর জীবনপঞ্জি, লটারি কেলেঙ্কারিতে সেই মার্টিনের নাম এলেও তাঁকে কি ধরাছোঁয়ার মধ্যে পাবেন তদন্তকারীরা?