বৃহস্পতিবার গোয়া যাওয়ার কথা মমতার। ফাইল চিত্র
আকাশপথে দূরত্ব ১,৭০০ কিলোমিটার। আর সড়ক পথে প্রায় ২,২০০ কিলোমিটার। কিন্তু সংস্কৃতি থেকে ভাষা— সবেতেই কলকাতা আর গোয়ার মধ্যে দূরত্ব অনেক। আগামী বুধবার সেই গোয়ায় যাচ্ছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের নেতাদের বড় অংশের মতে, মমতার এই সফরে ‘সাবালক’ হওয়ার পর্ব শুরু হবে তৃণমূলের। তাই তাঁর সফরের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে গোটা দেশের রাজনৈতিক মহল। তাকিয়ে আছে মমতার দল তৃণমূলও।
প্রসঙ্গত, কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে ১৯৯৮ সালে তৃণমূল গঠনের পর এই প্রথম কোনও একটি রাজ্যে এই ধরনের সফরে যাচ্ছেন মমতা। বাংলার বাইরে দলের জমি তৈরি করতে অতীতে অনেক তৃণমূল নেতা ত্রিপুরা, গুজরাত, গোয়া-সহ বিভিন্ন রাজ্যে গিয়েছেন। মমতা গিয়েছেন রাজনৈতিক প্রচারে। কিন্তু এই প্রথম মমতা একটি রাজ্যে যাচ্ছেন সরকার গঠনের প্রস্তুতির অঙ্গ হিসেবে। যে সফরের আগে মমতা টুইট করে সকলের সার্থন চেয়েছেন।
বস্তুত, গোয়া-সফরের মাধ্যমে যে পথে মমতা হাঁটতে শুরু করছেন, একদা ত্রিপুরায় সংগঠন বিস্তারের চেষ্টা দিয়ে তারই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল বলে মনে করছেন দলের বর্ষীয়ান নেতাদের একাংশ।
বাংলায় তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসেই অন্য রাজ্যে শক্তি বাড়ানোর লক্ষ্য নেয় তৃণমূল। ফাইল চিত্র।
গত কয়েকমাসে সেই ত্রিপুরায় তৃণমূলের উপস্থিতি অনেকাংশে বেড়েছে। সেখানকার শাসক বিজেপি-র সঙ্গে রাস্তার নেমে টক্কর দিতে শুরু করেছে তৃণমূল। দু’পক্ষের সংঘর্ষ, বিজেপি-র ‘হামলা’, তৃণমূল নেতাদের গাড়ি ভাঙচুরের মতো বিভিন্ন ঘটনায় ইতিমধ্যেই ত্রিপুরায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেছে তৃণমূল। পাশাপাশি, অসমেও তাঁদের দল অভিঘাত তৈরি করতে পারবে বলে তৃণমূল নেতারা দাবি করেছেন।
তৃণমূলের মানচিত্রে এর পরেই রয়েছে গোয়া। সেখানে আগামী ফেব্রুয়ারিতেই বিধানসভা ভোট। তৃণমূল সেখানে লড়তে তৈরি হচ্ছে। গোয়ার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরেই বলেছিলেন, তিনি দলকে বাংলার বাইরেও শক্তিশালী করতে চান। গোসাবায় উপ-নির্বাচনের প্রচারে গিয়েও অভিষেক বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আশীর্বাদ করেছেন। রাজ্যে বিজেপি বিতাড়নের কাজ সম্পূর্ণ। যেখানে যেখানে বিজেপি-র অত্যাচার লাগামছাড়া, সেখানে সেখানে পৌঁছবে তৃণমূল। ত্রিপুরায় কড়া নাড়া শুরু হয়েছে।’’
১৯৯৭ সালে কংগ্রেসের ‘প্লেনারি সেশন’ বলেছিল কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। তখন কংগ্রেস সভাপতি সীতারাম কেসরী। ‘বিক্ষুব্ধ’ নেত্রী মমতা ওই অধিবেশনে যোগ দেননি। তিনি তাঁর অনুগামীদের নিয়ে মেয়ো রোডে গাঁধূমূর্তির পাদদেশে ‘আউটডোর’ সমাবেশ করেন। পর্যায়ক্রমে মমতাকে দল থেকে বহিষ্কার করে কংগ্রেস। মমতা ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি তৃণমূল গঠন করেন।
তার পর তেইশটি বছর কেটে গিয়েছে। কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে মমতা পশ্চিমবঙ্গে নিজেই ‘আসল কংগ্রেস’ হয়ে উঠেছেন। বস্তুত, কংগ্রেস ছেড়ে মমতার মতো এমন বিপুল সাফল্য অতীতে আর কোনও নেতা পাননি। প্রণব মুখোপাধ্যায়, শরদ পওয়ার, পূর্ণ সাংমা, জিকে মুপানরের মতো নেতারা কংগ্রেস ছেড়ে নিজের নিজের রাজ্যে দল গড়েছিলেন। কেউই সাফল্য পাননি। কেউ কংগ্রেসে ফিরে এসেছেন। কেউ কেউ কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা বা জোটে গিয়েছেন। কিন্তু মমতা পশ্চিমবঙ্গে কার্যত পুরো কংগ্রেসকেই নিজের দলে টেনে নিয়েছেন। সঙ্গে টেনে নিয়েছেন কংগ্রেসের ভোটও। সে অর্থে কংগ্রেস-ত্যাগী নেতাদের মধ্যে মমতার সাফল্য নজিরবিহীন।
তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে সদ্যই দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি করা হয়েছে গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফেলেইরোকে। ফাইল চিত্র
শুরুতে তৃণমূল ছিল অনেকাংশেই আবেগ-নির্ভর। মূলত সিপিএমের কঠোর বিরোধিতা করাই ছিল সেই তৃণমূলের লক্ষ্য। ১৯৯৮ সাল থেকে চেষ্টা করতে করতে শেষপর্যন্ত ২০১১ সালে বাংলায় সিপিএম শাসনের অবসান ঘটনা মমতা। তার পর থেকে তাঁর লেখচিত্র ক্রমেই উপরের দিকে উঠেছে। পর পর তিনটি বিধানসভা ভোটে তিনি জিতেছেন। প্রতিবারেই তাঁর আসনের সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে প্রথম বার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট থাকলেও পরের দু’বার তিনি একাই বিধানসভা ভোটে লড়েছিলেন। কিন্তু মমতাকে রোখা যায়নি।
তবে অনেকে মমতার তৃণমূলের উত্থানের সঙ্গে অরবিন্দ কেজরীবালের আপ (আম আদমি পার্টি)-এর সাফল্যের তুলনা করেন। দেশের রাজধানী দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকার পাশাপাশি পঞ্জাব, গোয়া, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশেও শক্তিবৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে আপ (প্রসঙ্গত, উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের দু’জন নেতা সোমবারেই উত্তরবঙ্গ সফররত মমতার কাছে এসে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন)।
তবে আপ আর তৃণমূলের মধ্যে মূলগত তফাত রয়েছে। সমাজের উঁচুতলার লোকজন এবং বিশিষ্টজনেদের নিয়ে দুর্নীতি-বিরোধী প্রশ্নে কেজরীবাল তাঁর দল তৈরি করেছিলেন। নামে ‘আম (সাধারণ) আদমি’র দল হলেও। সাফল্য পাওয়ার পর কেজরীবাল নিচুতলায় সংগঠন গড়েছেন। আর মমতা তৃণমূল স্তরের লোকজনকে নিয়ে দল গঠন করে তার পর ক্রমশ উপরের দিকে উঠছেন। ফলে তাঁর উত্থান ক্রমে ঊর্ধ্বগামী। মমতার গোয়া-সফর ফলিত স্তরে তারই প্রতিফলন।
দলের নামের আগে ‘সর্বভারতীয়’ (অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস) শব্দটি থাকলেও নির্বাচন কমিশনের খাতায় সেই ‘স্বীকৃতি’ নেই তৃণমূলের। নিয়ম অনুযায়ী, কোনও দলকে সর্বভারতীয় স্বীকৃতি পেতে হলে তিনটি শর্তের যে কোনও একটি পূরণ করতে হয়। এক, দেশের কমপক্ষে তিনটি রাজ্য থেকে লোকসভার ২ শতাংশ আসনে জয়। দুই, কমপক্ষে চারটি রাজ্যে লোকসভা ভোটে ৬ শতাংশ ভোট এবং চারটি বা তার বেশি আসনে জয়। তিন, কমপক্ষে চারটি রাজ্যে সেই রাজ্যের দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হবে। বাংলায় বিপুল শক্তি নিয়ে ক্ষমতায় থাকলেও এখনও পর্যন্ত ওই তিন শর্তের কোনওটিই পূর্ণ হয়নি তৃণমূলের।
তবে তৃণমূল ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, নভেম্বরে ত্রিপুরার পুরভোটে অংশ নেবে দল। অসম, অরুণাচলপ্রদেশ-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যে তৃণমূল পুরনো জমি রয়েছে। এ বার গোয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য দলের প্রচারাভিযান শুরু হয়েছে।
অভিষেক বলেছেন, ‘‘দেড় বছরের মধ্যে ত্রিপুরায় তৃণমূল সরকার তৈরি করবে। শুরু হয়েছে গোয়া অভিযান। চারমাসের মধ্যে সেখানেও হবে সরকার। এর পর মেঘালয় এবং উত্তরপ্রদেশ।’’ সবক’টি বিজেপি শাসিত রাজ্যের কথা উল্লেখ করে অভিষেক আরও বলেন, ‘‘এখনকার তৃণমূল আর আগের তৃণমূলের পার্থক্য আছে। তিন মাসের মধ্যে পাঁচটি রাজ্যে বিজেপি-কে হারাবে তৃণমূল— এই শক্তি দল সঞ্চয় করেছে।’’