Ghoramara Island

আবাহনে নিশ্চয়তা খোঁজে ক্ষয়িষ্ণু দ্বীপ

নিঃঝুম দুপুরে নদীপাড়, দোকান-রাস্তা ফাঁকা-ফাঁকা। ইশারা করে বাঁধের ঢিবিতে উঠে গেলেন নিতাই। খালি গা, লুঙ্গির মতো করে জড়ানো গামছা।

Advertisement

রবিশঙ্কর দত্ত

ঘোড়ামারা শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২০ ০৩:৫৭
Share:

ঘোড়ামারায় চলছে মূর্তি গড়া। ছবি: মানস কারক

আশ্বিনের শেষে এসেও বেশ গরম। সকালেই ঘাম গড়াচ্ছে। নোনা হাওয়া গায়ে লাগলে প্রথমটা বুকপিঠে চিড়বিড় করে উঠছে। তাতেও জলের দুনিয়ায় এক দিনের এই নৌকাযাত্রা প্রমোদ ভ্রমণের থেকে কম কিছু নয়। ইঞ্জিনের কর্কশ শব্দও আগমনীর মতো বাজে শহুরে কানে। মিনিট তিরিশের এই পথেই তো যে কোনও ভ্রমণ সংস্থার বিজ্ঞাপনী ট্রেলার তৈরি হয়ে যেতে পারে। শিশির মাখা ভোর। ময়ূরকণ্ঠী বিকেল। নীলের মধ্যে পাহাড়ের মতো সাদা মেঘ, আড়ালহীন সূর্য আর পাড়ের অস্পষ্ট সবুজ রেখা। দুর্যোগে জেটি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে ঘাটে ওঠা-নামা করার জন্য কাদা মুছে কাঠের তক্তা পেতে হাসিহাসি মুখে ঘোড়ামারায় নামিয়ে দেন ট্রলারের হেল্পার বিকাশ।

Advertisement

খেয়াঘাট থেকে সাইকেলভ্যান। সামনের তেঁতুলতলা ছাড়ালেই নতুন মানুষ পুরনো হয়ে যান কিশোর চালকের কাছে। ধীরে ধীরে আলাপে সাড়া দেয় বেরাপাড়ার সন্তু। তার পর ইট পাতা রাস্তা, টলটলে পুকুরে শাপলা-শালুক সরিয়ে হাঁসের সাঁতার। নিকোনো উঠোনে ছড়িয়ে রাখা ধান-চাল, ছোটবড় খড়ের গাদা, গরুর জাবনার চাড়া। এ সবের ফাঁকে-ফাঁকে সবুজ ধানখেত। এখানে দুধেশ্বর চাল খুব ভাল হয়। আর মিঠাপাতার পানবরজ। শাপলা ফুটে রাতের বিল-জল একেবারে তারা ভরা আকাশ। তবু উদাস, বিক্ষিপ্ত চারপাশ। উৎসবের আগে অভিমানের গুমোট গোটা দ্বীপ জুড়ে। অতিমারি কোভিডের সংক্রমণ নেই এখানে। তবু কী উদাসীনতা। — তোদের এখানে পুজো হচ্ছে না রে? ভ্যানের প্যাডেলে চাপ দিয়ে সন্তু বলল, ‘‘হচ্ছে বোধ হয়।’’ — সে কী রে, গ্রামের পুজোর খবর রাখিস না! মুরগিছানার মতো হলুদ হাবলফুলের গা ছুঁয়ে এগিয়ে গেল ভ্যানের চাকা।

গোঁফের রেখা স্পষ্ট হচ্ছে, অথচ পুজোর কথায় এমন সংক্ষিপ্ত জবাব কেন? কেমন সেই উৎসব, যা নিয়ে কথা এগোয় না? পড়া ছেড়ে অসমে তেল কোম্পানির পাথর ফাটানোর কাজ নিতে হয়েছিল। করোনায় বাড়ি ফিরে খেয়াঘাটে ভ্যান টানছে যে কিশোর, তার ঝুলিতে বোধ হয় মহালয়ার গল্প থাকে না। এ বার হয়তো পুজোই হত না। সরকার ৫০ হাজার টাকা দেবে জানানোর পরে মিটিং বসেছিল পুজোর। প্রকৃতির তাণ্ডব আর তা দেখেও বাকি দুনিয়ার উপেক্ষায় জমা অভিমান ঢাকা পড়তে শুরু করেছে ঠিকই, তবে তা তো মিলিয়ে যাওয়ার নয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত ঘোড়ামারায় জীবন আর জীবিকা ১২ মাসই সিঁটিয়ে থাকে নদী-ভাঙনের ভয়ে। জলবায়ু বদলাচ্ছে। আর তার ফলে চারপাশের জলস্তর বাড়ছে। লোহাচরা তলিয়ে গিয়েছে আগেই। সামান্য অবশিষ্ট আছে খাসিমারার।

Advertisement

ধাক্কা লাগছে বাগপাড়া, পাত্রপাড়া, গিরিপাড়া, মাইতিপাড়া বা বৈষ্ণবপাড়া, চুনপুরির গায়ে। বিঘে বিঘে চাষের জমি, বসতভিটে তলিয়ে গিয়েছে বটতলা, মুড়িগঙ্গা আর হুগলি নদীর জলে। সরকারি কাগজপত্র বলছে, লোকসংখ্যাও কমে এখন মাত্র হাজার চারেক। চোখের সামনে এ সব দেখেছেন এখানকার মানুষ। সেই সঙ্গে পরপর আয়লা, বুলবুল আর আমপানে তছনছ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা। তাই সাগর-নদীর পিঠে চড়ে নোনা হাওয়ায় সর্ব ক্ষণ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হারানোর যন্ত্রণা আর আতঙ্ক। ঘুম ভেঙে যাচ্ছে মাঝরাতে। খাসিমারা গ্রামের নিতাই ঘড়ুই এখনও স্পষ্ট দেখতে পান নিজেদের সর্বনাশ।

আরও পড়ুন: অসচেতন জনতা, ১৫ জেলায় ‘বিপদসঙ্কেত’ দেখছে স্বাস্থ্য দফতর​

আরও পড়ুন: বঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি সঙ্গত: অমিত

দেখতে পান, ‘‘বাড়ির উঠোনে চার-পাঁচটা গাদা। বিশ-বাইশ বিঘের ধান। সাত-দশজন লোক লাগিয়ে ঝাড়া-বাছা। দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করছেন বাবা।’’ ৫২ বছরের জীবনে তিন-তিন বার তাঁদের জমি-বাড়ি নদীতে তলিয়ে গিয়েছে। বেরাপাড়ার সন্তুর মতো মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ না হতে পড়া ছাড়তে হয়েছিল নিতাইকেও। ৩০-৪০ বছর আগে। ৪০০ টাকার আনাজ ধরিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন কাপড়ের দোকানি বাবা নগেন্দ্রনাথ। বাইরের বেঞ্চে বসে দেখছিলাম নিতাইয়ের সেই দোকান।

ঘোড়ামারায় ভাঙন দেখাচ্ছেন নিতাই ঘড়ুই। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

কাঠের তক্তায় গোটাকতক প্লাস্টিকের বয়াম। কোনওটায় ঝাল লজেন্স, কোনওটায় টকমিষ্টি, হজমিবড়ি, খেলনা মুখোশ। বাঁশে জড়ানো দড়িতে সার দেওয়া প্লাস্টিকের ঠোঙায় লম্বু, আটার গজা, দাড়ি কাটার ব্লেড, পেন-পেন্সিল, শ্যাম্পুর পাতা, সাবান, ব্যাটারি। মিলেমিশে নুন, তেল, আলু, পেঁয়াজ আর সামান্য আনাজ। টালিচালার ঘুপচি দোকানঘর, দাঁড়িপাল্লায় তাজা একটা জবা গুঁজে রেখেছেন নিতাই। মায়ের নামে নাম রাখা সেই ‘সিদ্ধেশ্বরী ভাণ্ডার’ এখন ঘড়ুইদের পাঁচটা পেট টানতে পারে না। ভিতর থেকে নিতাই বলছিলেন, ‘‘গল্প-কথা নয়। যে খাসিমারায় আপনি বসে, তা তো এখন একটা ফালি। নদীর খিদে। সব খাবে।’’ নিঃঝুম দুপুরে নদীপাড়, দোকান-রাস্তা ফাঁকা-ফাঁকা। ইশারা করে বাঁধের ঢিবিতে উঠে গেলেন নিতাই। খালি গা, লুঙ্গির মতো করে জড়ানো গামছা। বললেন, ‘‘ওই দেখছেন পাতা ভাসছে, ওখানে কালী মন্দির, আর তার এ পাশটায় শীতলা মন্দির, পিছনে হরি মন্দির। ফাল্গুন মাসে উৎসবের সময় এ জায়গায় তো লোক আর লোক।’’ হাত ঘুরিয়ে নিতাই যে সব দিক দেখালেন, তার কোথাও অবশ্য জল ছাড়া কিছু নেই। মাটি-গোলা নোনা জল জমে চার দিকে। তাতে অবশ্য ভ্রুক্ষেপ নেই। নিতাই বলছেন তাঁর আর তাঁর মতো হাজার মানুষের অতীত। খাসিমারার শেখ আফতাবুদ্দিন, মন্দিরতলার নারায়ণ মাপা, হাইস্কুলের কেরানি বিজয় মাইতির অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা। গল্প নয় ঠিকই, তবে তা গল্পের মতো শোনাচ্ছিল। মন্দিরের চিহ্নমাত্র নেই। পীরের দরগা নড়ে গিয়েছে। গাঁয়ে গরু বিয়োলে মায়ের প্রথম দুধ এই দরগায় চড়ে এখনও। জল যাচ্ছে মসজিদের দিকে। নিতাই বললেন, ‘‘এ দিক-ও দিক জুড়ে বাজার। তা সরে গিয়েছে পঞ্চায়েত অফিসের সামনে। যেখানে আপনি দাঁড়িয়ে, সে তো ক্লাব ছিল। যুব সংঘ।’’ হাঁ করা নদীর মুখে তবু জীবন থেমে থাকে না। চা-দোকানের দরমার দরজায় লুডো প্রতিযোগিতার ‘আনন্দ সংবাদ’। তাসের আড্ডায়, বাজারি গজল্লায়, চার মাথার ধোঁয়ায় ভেসে বেড়ায় পুরনো যাত্রাপালা। লম্বা লাইন পড়ে মাজেদ শেখের রেশন দোকানে। তাল, নিম আর খেজুর গাছের গা ছুঁয়ে কানে আসে ট্রানজিস্টরের গান ‘ময়না বলো তুমি কৃষ্ণ-রাধে...।’ জীবনের সেই নিয়মেই হাটখোলা মাঠের পুব দিকে নবারুণ সংঘের বারান্দায় কাঠামোয় খড় পড়েছে, মাটিও। গঙ্গাসাগর থেকে শিল্পী এসেছেন। পুজোর মণ্ডপ ঘিরে হাসিও ফিরছে গল্পে। আড্ডা শুরু হয়েছে মেয়ে-বৌদের। সেই আড্ডায় কিন্তু দীর্ঘশ্বাসও পড়ছে। কারক ডাক্তারের স্ত্রী চম্পা দিদিমণি, মণ্ডলদের দুই জা— মেনকা আর ঝর্ণা, প্রাইমারি স্কুলের পাশের বাড়ির অষ্টমী, মাধবী— তিন-চার দিনের উৎসবের কল্পনায় ভাসছেন। পর ক্ষণেই হাতজোড়া মাথায় ছুঁইয়ে বলছেন— ‘‘আর তো কেউ দেখে না মা, তুমিই দেখো ঘোড়ামারাকে। বছর বছর এসো।’’ এই আবাহনেই নিশ্চয়তা খুঁজছে দুধেরসর চাল আর মিঠেপাতার পানবরজের ক্ষয়িষ্ণু দ্বীপ। সেই সমবেত আর্তিতেই থালায় সাজবে নৈবেদ্য। হৃদয় পুড়বে। মণ্ডপে জ্বলবে প্রদীপ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement