মুড়িগঙ্গা নদীর ঘোড়ামারা ঘাটে বিলি করা ত্রাণের খাবার নিয়ে ফিরছে দুই শিশু। ছবি: দিলীপ নস্কর
ঘোড়ামারার ভাঙা নদীবাঁধের পাশেই ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন বছর চল্লিশের বরুণ প্রামাণিক। পাশে দাঁড়াতেই উত্তাল সমুদ্র দেখিয়ে বললেন, “একসময় লোহাচরায় থাকতাম। সমুদ্রে গিলে খেয়েছে সেই দ্বীপটাকে। সেখান থেকে সুপারিভাঙাচরায় উঠে আসি। সেটা তলিয়ে গেলে চলে আসি ঘোড়ামারায়। এই দ্বীপও আর বেশি দিন টিকবে না। এর পরে কোথায় যাব, জানি না।”
মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এই ঘোড়ামারা দ্বীপকে ঘিরে রয়েছে নদী ও সমুদ্র। ইয়াসে দ্বীপের প্রায় সাড়ে ছ’কিলোমিটার নদী বাঁধের পুরোটাই ভেঙে পড়েছে। ভেসে গিয়েছে গোটা দ্বীপটাই। কৃষিজমি, পানের বরজ, মাছের পুকুর সবই চলে যায় নোনা জলের তলায়। ঝড়ের এক সপ্তাহ পর, বৃহস্পতিবার কাকদ্বীপের লট ৮ ঘাট থেকে কোনও রকমে ফেরির ব্যবস্থা করে ফুঁসে ওঠা নদী পেরিয়ে পৌঁছনো গেল ঘোড়ামারায়। খেয়াঘাটের অবস্থা দেখে প্রথমেই চমকে উঠলাম। জলের তোড়ে ঘাট বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। দ্বীপে জল অবশ্য কিছুটা নেমেছে। তবে দুর্গতি কমেনি। খেয়াঘাট থেকে বেরিয়ে একটা কংক্রিটের রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে ঘোড়ামারা পঞ্চায়েত কার্যালয় পর্যন্ত। সেই পথে রাস্তার উপর পড়ে রয়েছে অজস্র বালিশ, কাঁথা, লেপ, তোষক। স্থানীয়রা জানালেন, জলে ডোবা ঘর থেকে কোনও রকমে জিনিসগুলো বের করে এনেছেন। রোদ উঠতে রাস্তায়
ফেলে রেখেছেন।
দ্বীপের অধিকাংশ মানুষই এখনও রয়েছেন ত্রাণ শিবিরগুলিতে। কেউ কেউ উঁচু জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে আছেন। স্থানীয় প্রশাসন, সুন্দরবন পুলিশের তরফে রান্না করা খাবার
বিলি হচ্ছে। বহু বেসরকারি সংস্থাও ত্রাণ বিলি করছে। সকাল থেকে সেই ত্রাণ নেওয়ার জন্য ভিড় জমছে খেয়াঘাটে। অনেকেই জানালেন, ঝড়ের পর প্রথম তিন-চার দিন খাবার জোটেনি। তার পর থেকে ত্রাণ মিলছে। তবে রান্না করা খাবার পৌঁছচ্ছে না দ্বীপের সর্বত্র। পানীয় জলেরও সমস্যা রয়েছে।
শুকনো খাবার খেয়েই দিন কাটছে অনেকের। তিলকবালা সর্দার বলেন, “প্যাকেটে করে মুড়ি-চিঁড়ে দিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। তাই খেয়েই আছি। চাল-ডালও দিয়েছে। কিন্তু হাঁড়ি-কড়াই তো নেই! সব ভেসে গিয়েছে।”
গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিবিরে দেখা হল ফিরোজা বিবির সঙ্গে।
বটতলা নদীর পাশেই বাড়ি ছিল ফিরোজার। ঝড়ের সময় স্বামীর সঙ্গে বাড়িতেই ছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, “জল ঢোকা শুরু হতেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসি। একটা পাটকাঠির স্তূপের উপর কোনওরকমে আশ্রয় নিই। নদীর এমন ভয়াবহ রূপ কখনও দেখিনি। পরপর ঢেউ এসে আছাড়ে পড়ছিল। দু’জন দু’জনকে কোনওরকমে জাপটে ধরে রেখেছিলাম। সকাল ৯টা থেকে প্রায় ৫টা পর্যন্ত এ ভাবেই কাটে। ফিরে এসে দেখি ঘরটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।”
শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শেখ সাহাবুদ্দিন, শেখ রহমতরা জানান, ঢেউয়ের তোড়ে কেউ বাবলা গাছে, কেউ খেজুর গাছে আশ্রয় নিয়ে কাটিয়েছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাপস মণ্ডল, নিখিল দলুইরা জানান, ঘর ছেড়ে আগেই এসে উঠেছিলেন প্রাথমিক স্কুলে। কিন্তু জলের স্রোতে একসময় মনে হচ্ছিল স্কুলবাড়িটা ভেঙে পড়বে। ভেঙে পড়া এক পানের বরজের পাশে দেখা হল বছর ষাটের পরমেশ্বর গিরির সঙ্গে। বৃদ্ধ বললেন, “গত বার আমপানেও তিনটে বরজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রায় এক লক্ষ
টাকা ঋণ নিয়ে এবার কোনওরকমে দাঁড় করিয়েছিলাম। ফের গেল। বাড়িতে মজুত চাল, মেয়ের বিয়ের গয়না সবই ভেসে গিয়েছে। এখন কী করব বলতে পারেন?”
ঘোড়ামারার দক্ষিণে আরও দু’টি দ্বীপ ছিল একসময়। লোহাচরা আর সুপারিভাঙাচরা। সমুদ্র এগিয়ে এসে ক্রমে গিলে খেয়েছে সেই দ্বীপদু’টিকে। দ্বীপের বাসিন্দারা কেউ ঘোড়ামারায় উঠে এসেছেন, কেউ চলে গিয়েছেন অন্যত্র। বাসিন্দাদের আশঙ্কা, এভাবে বাঁধ ভাঙতে ভাঙতে খুব শীঘ্র ঘোড়ামারাও তলিয়ে যাবে সমুদ্রের গ্রাসে। বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় গত কয়েকবছর ধরেই কমছে দ্বীপের জনসংখ্যা। বর্তমানে হাজার পাঁচেক বাসিন্দা রয়েছেন। তাঁদের অনেকেই ইয়াসের পর ইতিমধ্যেই কাকদ্বীপ, সাগরে আত্মীয়ের বাড়ি চলে
গিয়েছেন জিনিসপত্র নিয়ে। বাসিন্দারা অনেকেই চাইছেন, তাঁদের অন্যত্র পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুক সরকার। ঘোড়ামারা পঞ্চায়েতের প্রধান সঞ্জীব সাগর বলেন, “সত্যিই এই দ্বীপের আর ভবিষ্যৎ নেই। বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই ভাল হয়।”
সাগরের বিধায়ক ও সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী বঙ্কিম হাজরা অবশ্য বলেন, “ওই দ্বীপের ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত শুরু হবে। তাছাড়া পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সকলের কাছে খাবার ও পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।”