কারিগরি প্রযুক্তি শিক্ষার চাহিদায় এখন ভাটার টান। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রয়োগ বাড়ছে উত্তরোত্তর। প্রতীকী চিত্র।
নব্বইয়ের দশকের শেষাশেষি ছবিটা পাল্টাতে শুরু করে। ২০১২ থেকে তার পাল্টে যাওয়াটা আরও অনেকখানি। কারিগরি প্রযুক্তি শিক্ষার চাহিদায় এখন ভাটার টান। বেশ কয়েক বছর ধরে আসনসংখ্যা ভরছে না অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই। অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অব টেকনিক্যাল এডুকেশন (এআইসিটিই)-এর নির্দেশে ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে দুশোরও বেশি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এ বছর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৬১টি বিষয়ও। শুধু তাই নয়, পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই নিজের পছন্দসই চাকরি পাচ্ছেন না। যাঁরা পাচ্ছেন তাঁদের অনেকে আবার বেশি দিন টিকতে পারছেন না একই চাকরিতে।
অন্য দিকে, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রয়োগ বাড়ছে উত্তরোত্তর। এই শাখায় উদ্ভাবিত হচ্ছে নতুন নতুন প্রশাখা। কম্পিউটার বিজ্ঞানের শাখায় যোগ হয়েছে অনেক নাম— বিগ ডেটা, অ্যানালেটিক্স, ব্লক চেন, সেন্সর টেকনোলজি, ক্লাউড কম্পিউটিং, ডেটা সায়েন্স, সাইবার সিকিউরিটি, আর্টিফিশিয়াল ইন্ট্যালিজেন্স, ফর্মেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং... ইত্যাদি। পাশাপাশি, মার্কেটিংয়ের হাতেও চলে এসেছে ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েব টেকনোলজি। এর সবগুলোই দুনিয়াজোড়া ইন্টারনেট প্রযুক্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত। আবার ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন্স প্রযুক্তিতে যোগ হয়েছে নতুন বিষয় রোবোটিক্স। মেক্যানিক্যালের সঙ্গে ইলেক্ট্রিক্যাল জুড়ে তৈরি হয়েছে মেকাট্রনিক্স।
স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের সঙ্গেও কারিগরি প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটছে দ্রুত লয়ে। যেমন বায়োটেকনোলজি, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, জেনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি। আগে কম সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এ সব পড়ানো হলেও বিগত কয়েক বছরে এই বিষয়গুলি পড়াতে শুরু করেছে অনেক কলেজই। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শাখা বা স্বাস্থ্যনির্ভর কারিগরি বিষয়গুলির চাহিদা আগামী কয়েক বছরে আরও বাড়বে। তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান বা গবেষণার ক্ষেত্রও। আর সবটাই চলবে আগামী বেশ কয়েক বছর ধরে।
আরও পড়ুন: জয়েন্ট পিছোনোর দাবি, কেন্দ্র অনড়ই
বিজ্ঞান পড়ুয়াদের এক বিরাট অংশেরই আগ্রহ থাকে ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি নিয়ে পড়ার। সেই চাহিদা কিন্তু কমেনি। সে কারণেই দেশজুড়ে বেড়েছে আইআইটি এবং এনআইটি-র সংখ্যা। এ ছাড়াও রয়েছে আইআইইএসসি, ট্রিপল আইটি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বা মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলি। এর সবগুলিতেই ভর্তির জন্য পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ফি বছর। প্লেসমেন্টের হারও প্রত্যেক কলেজেই ৯০ থেকে ৯২ শতাংশের বেশি।
আরও পড়ুন: নেটের অধিকার না থাকায় বাড়ছে সামাজিক অসাম্য, কোন পথে দেশ…
এরই পাশাপাশি নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হওয়া বেশ কিছু বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও সমানে পাল্লা দিয়েছে সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলির সঙ্গে। গত তিন বছরে তাদের অনেকেই জায়গা করে নিয়েছে এনআই র্যাঙ্কিং তালিকায়। এনআইআর অর্থাৎ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব র্যাঙ্কিং তালিকায় প্রতি বছর স্থান পায় দেশের সেরা ৩০০টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এ বছর পর্যন্ত এই তালিকাটি তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন দফতর।
তথ্যপ্রযুক্তি বা কম্পিউটার বিজ্ঞাননির্ভর কারিগরি শাখার আগমন কিন্তু ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার হাত ধরেই। সঙ্গে আছে ইলেক্টনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন্স শাখা। এগুলির চাহিদা এখনও আগের মতোই। স্মার্টফোনের দৌলতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও এই দু’টি বিষয় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছে। যে সব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এই বিষয়গুলি ভাল ভাবে পড়ানো হয়, শিল্পজগতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি অনেকেই তাদের ক্যাম্পাসিংয়ে আসে এবং অনেককেই নিয়োগপত্র দেওয়া হয়।
আসলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন পেশাদারী মনোভাবাপন্ন ছাত্রছাত্রীরাই। এঁদের বেশির ভাগই হয় কর্মমুখী, নয় বাণিজ্যিক মনোভাবাপন্ন। এঁদের সকলেরই স্বপ্ন হল সমাজকে, শিল্পজগতকে নতুন কিছু আবিষ্কার উপহার দেওয়া। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সঙ্গে আরও একটি কথা— এঁরা সকলেই অঙ্কে এবং পদার্থবিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শী। কারণ, লজিক্যাল থিঙ্কিং ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া অসম্ভব। তা সে কোডিংই হোক বা ম্যানুফ্যাকচারিং। তাই অঙ্কে ভাল পড়ুয়ারাই যে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভাল করবেন, তা নিয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই।
(লেখক জেআইএস গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার)