সুবীর চাকী খুনের ঘটনায় আটক হল বাপি মণ্ডল এবং জাহির গাজী। নিজস্ব চিত্র।
নিঝুম রাতে কুকুর চিৎকার করছে কেন? কুকুর সতর্ক করতে চাইছে, অনুমান করেই বাড়ি ছেড়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমার এক অন্ধকার দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিল সে। জল পেরিয়ে গিয়ে রাতভর গোটা দ্বীপে উথালপাথাল তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ গড়িয়াহাটের কাঁকুলিয়া রোডে কর্পোরেট-কর্তা সুবীর চাকী এবং তাঁর গাড়িচালক রবীন মণ্ডলকে খুনের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে জাহির গাজি নামে ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। ধরা পড়েছে বাপি মণ্ডল নামে অন্য এক অভিযুক্তও। দু’জনেই জোড়া খুনে জড়িত থাকার কথা কবুল করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এই নিয়ে গড়িয়াহাটের হত্যাকাণ্ডে তিন জন গ্রেফতার হল।
পুলিশি সূত্রের খবর, জোড়া খুনের অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রকারী ভিকির মা মিঠুকে জেরা করেই বাপি-জাহিরের নাম উঠে আসে। গত রবিবার খুনের পরে দু’দিন বাড়িতে থাকলেও মঙ্গলবার থেকে আত্মীয়ের বাড়িতে গা-ঢাকা দিয়েছিল বাপি ও জাহির। পাথরপ্রতিমার জি-প্লটে বুড়াবুড়ির তটে বৃহস্পতিবার রাতে বাপিকে তার এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে আটক করা হয়। রাতের অন্ধকারে পুলিশকে দেখে কুকুর চিৎকার শুরু করায় জাহির ঘর ছেড়ে নিকটবর্তী এক দ্বীপে পালিয়ে যায়। সারা রাত গোয়েন্দারা দ্বীপের বিভিন্ন অংশে তল্লাশি চালিয়ে শুক্রবার সকালে তাকে আটক করে লালবাজার নিয়ে আসেন। টানা জিজ্ঞাসাবাদের পরে দু’জনেই জোড়া খুনে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে নেয়।
লালবাজার জানিয়েছে, জাহির-বাপির বাড়ি ডায়মন্ড হারবারের মঞ্জিতার মোড়ের কাছে। জোড়া খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত মিঠু হালদার মাস চারেক আগে ওখানেই বাড়ি ভাড়া নেয়। বাপির পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয় তার। বাপি রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করত। জাহির ভ্যানে ইমারতি মালপত্র নিয়ে যেত। আজ, শনিবার ধৃতদের আলিপুর আদালতে তোলা হবে। কলকাতা পুলিশের এক কর্তা জানান, জাহির-বাপি খুনের দিন অকুস্থলে উপস্থিত থাকার কথা কবুল করেও খুনের দায় পুরোপুরি চাপিয়েছে পলাতক ভিকির উপরেই। বলেছে, ‘কাজ’ আছে বলে তাদের ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যদিও পুলিশ তাদের এই বক্তব্য মানতে রাজি নয়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘটনার কয়েক দিন আগে মিঠু ও ভিকি খুন ও লুটপাটের ছক কষে। ভিকি মিঠুকে বলে সুবীরবাবুর বাড়িতে হানা দিয়ে টাকা আনবে। কাজ হাসিল করতে বাপি, জাহির ছাড়াও আর এক জনকে জোগাড় করে মিঠু। জেরার মুখে মিঠু পুলিশকে জানিয়েছে, ট্রেনে যাতায়াতের সূত্রে ওই তিন জনের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল। ধৃতদের পুরনো অপরাধের রেকর্ড আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অন্য এক জনকে জোগাড় করে ভিকি।
পুলিশি সূত্র জানায়, মিঠু কিছু দিন আগে বাপির বাড়িতে গিয়ে বলে, কলকাতায় কাজ জোগাড় করে দেবে। বিজয়ার পরের দিন মিঠু বাপিকে জানায়, কাজ ঠিক হয়েছে। ১৭ অক্টোবর বিকেল ৪টের মধ্যে পৌঁছতে হবে কলকাতায়। সেই অনুযায়ী বাপি, জাহির এবং অন্য এক যুবক ডায়মন্ড হারবার স্টেশনে যায়। মিঠু টিকিট কেটে রেখেছিল। সেখান থেকে একা ঢাকুরিয়ায় পৌঁছয় মিঠু। বাকিরা পরের ট্রেনে আসে বালিগঞ্জ স্টেশনে। সেখানে অপেক্ষা করছিল ভিকি।
তদন্তকারীরা জানান, আগে থেকে ছক কষে সুবীরবাবুকে তাঁর কাঁকুলিয়া রোডের বাড়ি কেনার জন্য ডেকে পাঠায় ভিকি। খুনের উদ্দেশ্যে ছুরি কিনেছিল সে। স্টেশন থেকে ভিকি-সহ পাঁচ জন চলে যায় ওই বাড়িতে। জেরায় মিঠু তদন্তকারীদের জানিয়েছে, সে স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। খুনের পরে মাকে ফোন করে সব জানায় ভিকি। তার পরেই ট্রেনে মিঠু এবং বাকিরা ফিরে যায়। ভিকি চলে যায় ফার্ন রোডে। সেখানে নির্মীয়মাণ একটি বহুতলে সুপারভাইজ়ারের কাজ করে সে। ওই বহুতলের শ্রমিকেরা শুক্রবার জানান, ভিকি সেখানে টিনের অস্থায়ী ঘরে থাকত। তার খোঁজে পুলিশ কয়েক বার ঘুরে গিয়েছে।
পুলিশি সূত্রে জানা গিয়েছে, বাপি, জাহির-সহ বাকিরা রাত ৮টা নাগাদ এলাকায় ফেরে। বাপির স্ত্রী বন্দনা এ দিন বলেন, ‘‘ঘটনার পরে বাড়ি ফিরে ওর হাত-পা কাঁপছিল। বার বার বলছিল, ‘আমাকে বাঁচাও। আমি খুন করিনি। ভিকিই গলায় ছুরি চালিয়ে খুন করেছে’।’’ বন্দনার দাবি, যাকে মারা হবে, তাঁর হাত-পা ধরে রাখার জন্য বাপি-সহ তিন জনের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার টোপ দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মিঠু। বাপি স্ত্রীকে জানিয়েছিল, হাত-পা ধরার আগেই ভিকি ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলায় কোপ মারে। বাপিকে কোনও টাকা দেওয়া হয়নি বলে জানান বন্দনা। জাহিরকে ফাঁসানো হয়েছে বলে তার বোন নুরজাহান খাতুনের দাবি। নুরজাহান জানান, লকডাউনের পরে তার দাদার কাজ কমে গিয়েছিল।
তদন্তকারীরা জানান, ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত বছরখানেক আগে। ভিকি জানতে পারে, তার বাবা সুভাষ হালদারের কাছে ১২-১৩ লক্ষ টাকা আছে। সুবীরবাবুর বাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে ভিকি বাবাকে নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে। তবে বাড়ির দাম কয়েক কোটি টাকা শুনে ফিরে যায়। পরে বাবার জমানো টাকা আদায়ের জন্য তাঁকে খুনের চেষ্টা করে ভিকি এবং তার মা। ভিকির ধারণা হয়, সুবীরবাবুর অনেক টাকা আছে। সেই টাকা হাতানোর জন্যই ক্রেতা সেজে ১৭ অক্টোবর কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িতে পৌঁছয়। সুবীরবাবুকে খুন করে ভিকিরা সোনার আংটি, কিছু ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড ছাড়া কত টাকা নিয়ে গিয়েছে, তা জানায়নি পুলিশ।
সুবীরবাবু ও রবীনবাবুর মধ্যে কাকে প্রথমে খুন করা হয়েছিল, পুলিশ তা-ও জানাতে পারেনি। খুনে ব্যবহৃত অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। ঘটনার পরের দিন সকালে মিঠুকে ফোন করে ডেকে এনে নিজের জিনিস, রক্তমাখা জামা-সহ দু’টি ব্যাগ তার হাতে তুলে দিয়েই গা-ঢাকা দেয় ভিকি।