সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারি। জাগরী বাস্কের বাড়িতে। —নিজস্ব চিত্র
মাঝরাতে বাড়ির দোরগোড়ায় নিঃশব্দে গাড়ি এসে দাঁড়ায়। হেডলাইটের আলো দপ করে নিভে যায়। কারা যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলে। অন্ধকারে ভাল ঠাহর হয় না।
ওরা কারা?
ধড়ফড়িয়ে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন। আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন না। ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত রেখে সিসিটিভি’র পর্দার দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকেন। অজানা আতঙ্কে বুক কেঁপে কেঁপে ওঠে মায়ের।
ভয় পান জাগরী। জাগরী বাস্কে!
একটা সময় জঙ্গলমহলের বিশাল তল্লাট তাঁদেরই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। শাসকদলের নেতা-কর্মী থেকে আম গ্রামবাসী, মায় পুলিশ— সকলের ঘুম কেড়েছিল জাগরী-রাজারাম বাহিনী। তাদের গুলিতে কার পাঁজর ঝাঁঝরা হয়ে যাবে, টাঙ্গির কোপে কার মাথা ছিটকে পড়বে ধড় থেকে আলাদা হয়ে, তার আগাম কোনও আন্দাজ মিলত না। ওঁদের পাকড়াও বা খতম করতে যৌথবাহিনী কম অভিযান চালায়নি। সব নিষ্ফল হয়েছে।
এবং নিজে থেকে ধরা দেওয়ার পরে সেই প্রাক্তন মাওবাদী গেরিলা দম্পতিই এখন ভয়ে কাঁটা হয়ে কার্যত ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। কারণ তাঁরা ‘খবর’ পেয়েছেন, জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা আবার ভিত গাড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রাক্তন সহযোদ্ধাদের বদলা-হানার আশঙ্কায় রাতের ঘুম উবেছে আত্মসমর্পণকারী দম্পতির। ‘শত্রু’র উপরে নজর রাখতে তাঁরা বাড়ির
ছাদে বসিয়েছেন সিসি ক্যামেরা। নিজেদের খরচে।
রাজ্য পুলিশের রেকর্ড বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১১-য় আত্মসমর্পণের আগে পর্যন্ত ঝাড়খণ্ডের লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গে প্রথম সারির মাওবাদী নেতা ছিলেন রাজারাম। জাগরীর উত্থান তার অনেক পরে। এই যুগলই ২০০৫-০৬ সালে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে মাওবাদী প্ল্যাটুন গড়ে তোলেন। বিয়েও সেই সময়ে। পুরুলিয়ার বরাভূম স্টেশনে আরপিএফ জওয়ানদের হত্যা করে অস্ত্র লুঠ ও পার্থ-সৌম্যজিতকে খুন-সহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে রাজারামের নামে। আর জাগরীর বিরুদ্ধে অন্তত সাতটি বড় মামলা। যার মধ্যে রয়েছে বান্দোয়ানে সিপিএম নেতা রবীন্দ্রনাথ করকে সস্ত্রীক খুন, শিলদায় ইএফআর ক্যাম্পে হানাদারি, সাঁকরাইল থানায় ঢুকে পুলিশকে খুন-অপহরণ ইত্যাদি।
এ হেন হাই প্রোফাইল মাওবাদী দম্পতি সমাজের মূল স্রোতের টানে মহাকরণে এসে ধরা দিলেন। সেটা ছিল ২০১১-র ১৭ নভেম্বর। সাত দিন বাদে বুড়িশোলের জঙ্গলে যৌথবাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে প্রাণ হারালেন মাওবাদী শীর্ষ নেতা কিষেণজি।
সেই ইস্তক রাজারাম-জাগরীর ঠিকানা পুলিশের ‘সেফ হাউস।’ কলকাতার অদূরে এক শহরের উপকণ্ঠে কাঠা তিনেক জমির উপরে পুরনো একতলা সরকারি আবাসন। হোমগার্ডের ‘চাকুরে’ হিসেবে দু’জনের মিলিত উপার্জন মাসে মোটামুটি হাজার কুড়ি টাকা। তবে ওঁদের কাজে যেতে হয় না। একমাত্র ছেলে পড়ে শহরের এক ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে। ক্লাস ওয়ান।
নির্ঝঞ্ঝাট সংসার, সাদামাটা জীবন। তা-ও পুলিশের ঘেরাটোপে। একদা জঙ্গলমহলে ত্রাস সৃষ্টিকারী দম্পতি তবু কেন ভয়ে কুঁকড়ে?
উত্তর খুঁজতে জুলাইয়ের এক বৃষ্টিভেজা দুপুরে পৌঁছানো গিয়েছিল ওঁদের গোপন আস্তানায়। বাড়ির এক দিকে পাঁচিল, অন্য তিন দিকে তার-জালির বেড়া। কড়া নাড়তে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন বছর চল্লিশের রাজারাম সোরেন ওরফে সাগেন সাওঁতাল। সাংবাদিক শুনে স্পষ্ট বিরক্তি— ‘‘কিছু বলার নেই।’’ তত ক্ষণে সিসিটিভি’র পর্দায় অতিথিদের চেহারা যাচাই করে নিয়ে বেরোলেন জাগরী। সালোয়ার-কামিজের উপরে গামছা জড়ানো। হুঁশিয়ার করলেন, ‘‘ছবি তুলবেন না। সিসিটিভির ছবি তো নয়ই।’’
বেশ কিছু ক্ষণ বোঝানোর পরে প্রবেশের অনুমতি মিলল। আড়াইখানা ঘর। সঙ্গে রান্নাঘর, বাথরুম, বারান্দা। আসবাব বলতে একটা খাট, আলমারি, সোফা, গুটিকয় প্লাস্টিকের চেয়ার। আর টেলিভিশন। বসতে বলে জাগরীর মন্তব্য, ‘‘অনেক কিছু বলার আছে। বলতে পারি না।’’ একটু থেমে বলেন, ‘‘রাত-বিরেতে গাড়ি এসে দাঁড়ায়। অচেনা কারা ঘোরা-ফেরা করে। সিসিটিভি থাকায় বুঝতে পারি।’’ পুলিশকে জানাননি?
‘‘জানিয়েছি। পাত্তাই দেয়নি।’’— জবাব প্রাক্তন মাওবাদী নেত্রীর। তাঁর আক্ষেপ, ‘বারবার বলা সত্ত্বেও পুলিশ তো সিসি ক্যামেরা লাগাল না! বাধ্য হয়ে আমরাই লাগিয়েছি।’’ জাগরীর অনুযোগ, আত্মসমর্পণের সময়ে রাজ্য সরকার যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। ছেলের পড়াশোনার খরচও বইতে হচ্ছে তাঁদেরই।
একরত্তি ছেলেকে ঘিরেই এখন জাগরী-রাজারামের যাবতীয় স্বপ্ন। রাজারাম ওকে পড়ান, স্কুলে দিয়ে আসেন, নিয়ে আসেন। বাজারহাট করেন। জাগরী সামলান হেঁশেল। জানালেন, শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। তাই অনেকটা সময় শুয়ে-বসে কাটে।
কিন্তু ভয়টা কীসের?
পুলিশকে জাগরীরা জানিয়েছেন, পুরনো সঙ্গীরা তাঁদের আত্মসমর্পণ ভাল ভাবে নেয়নি। কিছু ‘কমরেড’-এর সঙ্গে যোগাযোগের সুবাদে তাঁরা এ-ও আঁচ পেয়েছেন যে, মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে ফের জোট বাঁধছে। এবং এ বার তাঁরাও ‘টার্গেট’ হতে পারেন।
তাই সাবধানের মার রাখতে চাইছেন না। নিজেরাই সিসি ক্যামেরা বসিয়েছেন। দরজার সামনের বারান্দার উপরে, দু’দিকে। সিসিটিভি বসার ঘরেও। এমন জায়গায়, যাতে রান্নাঘর থেকে দেখা যায়। জাগরীর কথায়, ‘‘রান্না করতে করতেও উঁকি দিই।’’
পুলিশের যুক্তি: বাড়িতে আলাদা করে রক্ষী বা সিসি ক্যামেরা বসালে লোকের নজরে পড়বে। সেটা আরও বিপজ্জনক। কর্তাদের দাবি: ওঁদের সুরক্ষা নিশ্ছিদ্র। বাড়ির পাঁচশো মিটার দূরেই থানা। উপরন্তু সাদা পোশাকের পুলিশ নজর রাখছে। টহলদারি ভ্যান দিনে বহু বার টহল দেয়।
জাগরী-রাজারাম অবশ্য আশ্বস্ত হচ্ছেন না। তাঁদের উদ্বেগ-বার্তা নবান্নের কানেও পৌঁছেছে। স্বরাষ্ট্র দফতরের খবর: সম্প্রতি রাজ্য পুলিশের কিছু আধিকারিক ‘সেফ হাউসে’ গিয়ে ওঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এসেছেন। তাঁদের নিরাপত্তা সম্পর্কে নতুন কোনও চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে কি?
নবান্ন-সূত্রে তেমন ইঙ্গিত না মিললেও জাগরীর ‘খবর’কে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় বিবিধ গোয়েন্দা এজেন্সির সমন্বয় কমিটি সম্প্রতি সরকারকে রিপোর্ট দিয়ে বলেছে, জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা ফের সংগঠিত হচ্ছে। পশ্চিম মেদিনীপুর ও পুরুলিয়ার কিছু জায়গায় তাদের নিয়মিত আনাগোনা। বান্দোয়ানে তো সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর নামে পোস্টার পড়েছে! গোয়েন্দাদের হুঁশিয়ারি: জঙ্গলমহলের কিছু মানুষ সরকারের কাজকর্মে ক্ষুব্ধ। তাদের একাংশ মাওবাদীদের দিকে ঝুঁকছে। যার ফায়দা তুলে বর্ষার জঙ্গল ঘন হলেই মাওবাদী তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে। ফের তপ্ত হয়ে উঠতে পারে জঙ্গলমহল।
মাওবাদীদের এই ‘পুনরুত্থানের’ খবরই প্রাক্তনীর ঘুম কেড়েছে।