অরণ্যে বরাদ্দ বাড়ন্ত

ভরসা ছেঁড়া চটি-ভাঙা ডাল, পাহারায় বনকর্মীরা

তিরটা পিঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল তাঁর। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা বনকর্মীর হাত কয়েক দূরে পড়েছিল কাঠ-মাফিয়াদের সঙ্গে তাঁর অসম লড়াইয়ের এক মাত্র অস্ত্র, শিরীষ গাছের একটা ভাঙা ডাল। সেটা নিয়েই কাঠ-চুরি ঠেকানোর দায় চেপেছিল তাঁর কাঁধে।

Advertisement

রাহুল রায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৫ ০৩:৫২
Share:

তিরটা পিঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল তাঁর।

Advertisement

মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা বনকর্মীর হাত কয়েক দূরে পড়েছিল কাঠ-মাফিয়াদের সঙ্গে তাঁর অসম লড়াইয়ের এক মাত্র অস্ত্র, শিরীষ গাছের একটা ভাঙা ডাল। সেটা নিয়েই কাঠ-চুরি ঠেকানোর দায় চেপেছিল তাঁর কাঁধে।

বিষ মেশানো তির থেকে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, নাইট ভিশন লাইট, শক্তপোক্ত ল্যান্ডরোভার গাড়ি— জঙ্গল সাবাড় করতে আসা সুসজ্জিত কাঠ-মাফিয়াদের সঙ্গে বনকর্মী অনিল রায়ের লড়াই যে এ ভাবেই শেষ হওয়ার ছিল, মানছেন বনকর্তারা।

Advertisement

‘লড়াই’ শেযে অনিলবাবু কী পেয়েছেন? তাঁর স্ত্রী বলছেন, ‘‘দু’মাস চলে গিয়েছে। ক্ষতিপূরণ একটা টাকাও পাইনি।’’

বৈকুণ্ঠপুরের মন্দোদরী বিটের অনিল রায় নিছকই একটি উদাহরণ। সেই লম্বা তালিকায় রয়েছেন হরেকৃষ্ণ রায়, ভরত রায়, সুজিত মান্না—চলতি বছরের প্রথম চার মাসে রাজ্যের বন-সংরক্ষণে-বলি।

যাঁদের কেউ মহানন্দা অভয়াণ্যের সুকনা বিটে অন্ধকার রাতে হাতি তাড়াতে গিয়েছিলেন ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়া টর্চ নিয়ে, কেউ বা বাঁকুড়ার জঙ্গলে হাতির উপর নজরদারির জন্য জঙ্গলে পা রেখেছিলেন ছেঁড়া স্ট্র্যাপে সেফটিপিন লাগানো এক জোড়া হাওয়াই চটির ভরসায়।

যা হওয়ার তাই হয়েছে, ঢাল তরোয়ালহীন ওই বনরক্ষীদের হয় পিষে মেরেছে হাতি কিংবা পিঠ ফুঁড়ে দিয়েছে কাঠ-মাফিয়ার তির।

অনিলবাবুর সহকর্মীদের তাই প্রশ্ন, ‘‘স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে দাপিয়ে বেড়ানো চোরাশিকারিদের সঙ্গে কি ভাঙা ডাল নিয়ে লড়াই চলে, নাকি রাতের অন্ধকারে টর্চ ছাড়া হাতির গতিবিধির উপরে একা নজরদারি করা যায়?’’ তাঁদের অভিযোগ, আগ্নেয়াস্ত্র দূর অস্ত্, টর্চ, লাঠি, হাতি তাড়ানোর পটকা এমনকী এক জোড়া গামবুটও এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।

বন দফতরের নুন আনতে পান্তা ফুরানো এই হালটা প্রকট হয়ে উঠেছে এপ্রিলের গোড়া থেকে।

বনকর্তাদের একাংশের দাবি, ট্রেজারি আইনের জাঁতাকলে হাঁসফাঁস অবস্থাটা চলছিল বছর দুয়েক ধরে। চলতি আর্থিক বছর থেকে সঙ্গে দোসর জুটেছে অর্থ দফতরের এলওসি বা ‘লেটার অফ ক্রেডিট’-এর উপরে ফতোয়া জারি। ফলে হাতি-চিতাবাঘের হামলা ঠেকানো দূরে থাক বন্যপ্রাণীর হামলায় আকছার প্রাণহানির ঘটনার পরেও ক্ষতিপূরণ এখন বন দফতরে বাড়ন্ত।

রাজ্যে পালাবদলের পরে ট্রেজারি-বিধি চালুর পরে, অস্থায়ী বনকর্মীদের দৈনিক ভাতা থেকে জঙ্গলে নতুন চারা লাগানো, গাড়ির তেলের খরচ, নিদেনপক্ষে খাঁচা-জাল-হাতি খেদানোর পটকা কিনতেও ট্রেজারি ঘুরতে হত। অর্থাৎ, খরচের পরে তার যথাযথ হিসেব দিলে তবেই বন দফতরের সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে সে টাকা ফিরিয়ে দিত ট্রেজারি। কিন্তু ট্রেজারির লাল ফিতের ফাঁস গলে সে টাকা পেতে বছর ঘুরে যাচ্ছিল।

এক শীর্ষ বনকর্তা বলছেন, ‘‘আকস্মিকতায় ভরা বন দফতরের কর্ম-পদ্ধতির সঙ্গে এই বিধি বেমানান। ট্রেজারি পদ্ধতিতে আঠারো মাসে বছর। অস্থায়ী বনকর্মী তাঁদের ১৪০ টাকা দৈনিক ভাতার জন্য ট্রেজারির দিকে চেয়ে থাকবে?’’

তাই দফতরের আপৎকালীন এই খরচ এত দিন এলওসি-র মাধ্যমেই মেটানো হচ্ছিল। বাজেট বরাদ্দ টাকা অর্থ দফতরের অনুমোদন অনুযায়ী খরচ করার এলওসি পদ্ধতির উপরেও এ বার খাঁড়া নেমে আসায় মাথায় হাত পড়েছে বনকর্তাদের।

দফতরের শাসক দলের কর্মচারী সংগঠন ‘ফরেস্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশন’-এর সাধারণন সম্পাদক অমল সিংহ প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘অর্থ দফতরের আমলারা বন বিভাগের সমস্যা বা কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। তাঁরা নিজের মতো করে নিদান দিচ্ছেন আর তার হ্যাপা সামলাচ্ছে বন দফতর।’’

সেই হ্যাপার পরিসংখ্যান বলছে—তিন মাসে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে লোকালয়ে হাতির হানার ঘটনা যথাক্রমে—৩৭, ১৯ এবং ৩৩। সীমান্ত পেরিয়ে হাতি বাংলাদেশে পাড়ি দিলেও হুলাপার্টির অভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে বনকর্মীদের। বনকর্মী ছাড়াও হাতির হানায় মারা যান ১৩ জন গ্রামবাসী। নিয়ম মতো তাঁদের ২.৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। অমলবাবুর দাবি, ক্ষতিপূরণের টাকা মেটানো যাচ্ছে না বলেই পশ্চিম মেদিনীপুরের আমলাগড়া বা বাঁকুড়ার সোনামুখীতে জনরোষ আছড়ে পড়ছে। আক্রান্ত হচ্ছেন বনকর্মীরা, পুড়ছে বন-বাংলো।

কাঠ-মাফিয়াদের কাঠারির কোপে সদ্য হারিয়েছেন নিজের ডান হাতটা। বক্সার হ্যামিল্টনগঞ্জের বনকর্মী তারকনাথ রায় বলছেন, ‘‘উৎসবের জন্য সরকারের টাকা আছে, কিন্তু ক্ষতিপূরণের জন্য নেই।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement