ম্যাথু স্যামুয়েল
রহস্যভেদ দূরের কথা, তার মোড়কটাই খুলতে পারল না হায়দরাবাদের সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি!
নারদ স্টিং অপারেশনের ফুটেজ খাঁটি কি না, হায়দরাবাদের ওই ল্যাবরেটরি তা বলতে পারেনি। গত ২৯ এপ্রিল নারদ নিউজের হুল অভিযানের ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষার জন্য ওই ল্যাবরেটরিতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। তারা জট খুলতে না-পারায় এ বার যাচাইয়ের জন্য ওই ফুটেজ পাঠানো হচ্ছে চণ্ডীগড়ের কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে। ফুটেজ খাঁটি না ভুয়ো, এক মাসের মধ্যে বলতে হবে তাদের।
শুক্রবার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের ডিভিশন বেঞ্চে হায়দরাবাদের ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি থেকে পাঠানো রিপোর্ট খোলা হয়। ভরা এজলাসে রিপোর্ট পড়ে প্রধান বিচারপতি জানান, নারদ নিউজের কর্ণধার ম্যাথু স্যামুয়েলের ল্যাপটপের হার্ড ডিস্ক থেকে স্টিং অপারেশনের ফুটেজ পুনরুদ্ধারই করতে পারেনি ওই ল্যাবরেটরি।
কেন পারেনি?
প্রধান বিচারপতি বলেন, ল্যাপটপের হার্ড ডিস্ক থেকে ওই ফুটেজ পুনরুদ্ধার করার পারদর্শিতা তাঁদের নেই বলে হায়দরাবাদের ল্যাবরেটরি-কর্তৃপক্ষ রিপোর্টে জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা সুপারিশ করেছেন, চণ্ডীগড়ের কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি ফুটেজ পুনরুদ্ধার করতে পারদর্শী। ওই ফুটেজ সেখানে পাঠানো যেতে পারে। ডিভিশন বেঞ্চ আগামী ১০ দিনের মধ্যে ওই ফুটেজ চণ্ডীগড়ে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। চণ্ডীগড়ের ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির ডিরেক্টরকে ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ, ফুটেজ পাওয়ার এক মাসের মধ্যে তা পরীক্ষা করে রিপোর্ট পাঠাতে হবে।
নারদ-প্রধান ম্যাথু ২০১৪ সালে স্টিং অপারেশন করেন। ওই অপারেশনের ফুটেজে নির্বাচনের আগে রাজ্যের শাসক দলের প্রায় এক ডজন মন্ত্রী-সাংসদ-মেয়রকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিতে দেখা গিয়েছে। অভিযুক্তদের দাবি, ওই সব ফুটেজ ভুয়ো। স্টিং অপারেশনের ফুটেজ গত মার্চে জনসমক্ষে আসার পরেই হাইকোর্টে তিনটি জনস্বার্থের মামলা করা হয়। সেই সব মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি একাধিক বার বলেন, ওই ভিডিও ফুটেজ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপরে সাধারণ মানুষের আস্থা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। মানুষ জানতে চায়, ওই ফুটেজ খাঁটি না ভুয়ো। ‘‘ফুটেজটি সত্য হলে তা যেমন সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক, তেমনই মিথ্যা হলেও বিপজ্জনক,’’ বলেছেন প্রধান বিচারপতি।
রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র এ দিন ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানান, চণ্ডীগড়ের ল্যাবরেটরি-কর্তৃপক্ষ যাতে ফুটেজ পরীক্ষার রিপোর্ট গোপন রাখেন, সেটা নিশ্চিত করা হোক। ডিভিশন বেঞ্চ সেই আবেদন মঞ্জুর করে চণ্ডীগড়ের ল্যাবরেটরি-কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন, রিপোর্টের গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে।
নারদ-হুল নিয়ে ইতিমধ্যে আলাদা তদন্ত শুরু করেছে রাজ্য সরকার। কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে সেই তদন্ত চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষয়টি হাইকোর্টে বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও সরকার পৃথক তদন্ত শুরু করায় সেটা আদালত অবমাননার সামিল কি না, গত ২০ জুন প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে সেই প্রশ্ন তোলেন জনস্বার্থ মামলার এক আবেদনকারীর আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।
সরকারের তদন্ত প্রসঙ্গে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আগেই বলে দিয়েছেন, ‘‘কে কী করছে বা বলছে, সেটা বড় কথা নয়। এই নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চ যে-রায় দেবে, সেটাই শেষ কথা।’’ লালবাজার অবশ্য আলাদা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে পুরোদমে। কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম (সিট) ম্যাথু ছাড়াও তাঁর পরিচিতদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে ম্যাথু কলকাতায় এসে যাঁদের সঙ্গে দেখা করেন, তাঁদের বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছে সিট। ভোটের ঠিক আগে ম্যাথু কেন কলকাতায় এসেছিলেন, কে বা কারা তাঁকে আসতে বলেছিলেন, কোন ট্রাভেল এজেন্সির কাছ থেকে টিকিট কেটে ম্যাথু শহরে আসেন— সবই যাচাই করছেন তদন্তকারীরা।
লালবাজারের খবর, ম্যাথু হুল অভিযানের জন্য যে-ভাবে টাকা জোগাড় করেছিলেন, সেই প্রক্রিয়ায় তদন্তকারীরা কিছু অনিয়ম খুঁজে পেয়েছেন। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে কী ধরনের অনিয়ম, সেই বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন পুলিশকর্তারা। সব প্রশ্ন এড়িয়ে অপরাধ দমন বিভাগের আধিকারিক বিশাল গর্গ হাসতে হাসতে শুধু বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। সব দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
পুলিশের খবর, ২০১৪ সালে স্ট্রিং অপারেশনের সময় ম্যাথু যে-সব হোটেলে ছিলেন, সেখানকার সবিস্তার তথ্য জোগাড় করা হচ্ছে। মধ্য কলকাতার কয়েকটি হোটেলের রেজিস্টার খতিয়ে দেখা হয়েছে। ২০১৪-য় কাদের সঙ্গে ম্যাথুর যোগাযোগ হয়েছিল, কার বা কাদের মাধ্যমে তিনি শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তা জানতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বেশ কয়েক জনকে। খোঁজ নেওয়া হচ্ছে ম্যাথুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেরও। কে বা কারা ইউটিউবে নারদের ওই স্টিং ভিডিও আপলোড করেছিল, তা-ও জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা।
নারদ-তদন্তে ম্যাথুকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ই-মেল পাঠিয়েছে সিট। সেই মেলে তাঁকে অবিলম্বে হাজির হতে বলা হয়েছে লালবাজারে। নারদ-প্রধান সেই তলবি বার্তার জবাব দিয়েছেন কি না, পুলিশকর্তারা তা জানাতে চাননি। দেশের বাইরে থাকা ম্যাথু কবে কলকাতায় আসবেন, সেটাও নিশ্চিত নয়। একটি সূত্রের খবর, নারদ-হুল নিয়ে পুলিশি তদন্তের ব্যাপারে তাঁর আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করছেন ম্যাথু।
নারদ-কাণ্ড নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আলাদা তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পরে গত ১৮ জুন রাতে কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের (নারদের ফুটেজে তাঁরও ছবি দেখা গিয়েছে) স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায় পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। তার ভিত্তিতে পুলিশ নিউ মার্কেট থানায় নারদ নিউজের বিরুদ্ধে জালিয়াতি, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র-সহ চারটি ধারায় মামলা রুজু করেছে।