বিচারপতি সৌমেন সেন, ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দল, বিচারপতি হরিশ টন্ডন এবং সুব্রত তালুকদার। নিজস্ব চিত্র
পাঁচ বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ। এই বেঞ্চেই চলেছে তিন মাস ধরে শুনানি। সওয়াল করেছেন মহেশ জেঠমলানি, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি ও কপিল সিব্বলদের মতো দুঁদে আইনজীবীরা। অবশেষে রায়দান। রায়ে একই মত পাঁচ জনের। কারণ একটাই, তাঁরা মনে করেন সকলেরই বসবাস এবং স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। এই ঘটনায় তা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। আর তার প্রেক্ষিতেই উল্টে যায় বিবাদী পক্ষের সমস্ত যুক্তি। বৃহস্পতিবার ভোট পরবর্তী হিংসা মামলার রায়ে একই মত পোষণ করেন কলকাতা হাই কোর্টের পাঁচ বিচারপতি। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দল, বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, বিচারপতি হরিশ টন্ডন, বিচারপতি সৌমেন সেন এবং বিচারপতি সুব্রত তালুকদারের বেঞ্চ জানায়, বাংলায় ভোট পরবর্তী অশান্তি মামলার তদন্ত করবে সিবিআই ও বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। তদন্তের স্বার্থে তদন্তকারীদের সমস্ত রকমের সাহায্য করতে হবে রাজ্যকে।
বৃহস্পতিবার ভারপ্রাপ্ত বিচারপতি বিন্দল এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। তাঁর সঙ্গে সহমত জানান অন্য বিচারপতিরাও। কিন্তু যে হেতু এটি পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ, তাই প্রত্যেকেই তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেন। রায়ে বিচারপতি টন্ডনের মন্তব্য, ‘‘রাজা কখনও ভুল করতে পারেন না! প্রাচীন এই প্রবাদ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সাধারণ মানুষ, দার্শনিক এবং মননশীল মানুষের চিন্তাধারার মাধ্যমে এখন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে। কিন্তু যিনি রাজার দায়িত্ব পালন করেন, তাঁর তো রাজধর্ম পালন করা উচিত।’’ তাঁর মতে, ‘‘সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে আদালত কখনও নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। তাঁদের অধিকারের প্রশ্নেও আদালত উদাসীন হতে পারে না।’’
আবার বিচারপতি সেনের মতে, ‘‘মানুষ স্বাধীন এবং সমান অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। রাজ্যের দায়িত্ব মানুষের সেই অধিকারকে সুরক্ষিত রাখা। গণতন্ত্রে ভিন্ন মতের মানুষের বক্তব্য শুনতে হবে। এবং তা সম্মানও করতে হবে।’’ এই মামলায় বিচারপতি বিন্দল ছাড়া পাঁচ জনের মধ্যে প্রবীণতম হচ্ছেন বিচারপতি মুখোপাধ্যায়। তিনি এই রায়ে সহমত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর যুক্তি অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘রাজনৈতিক হিংসাকে শাসকদল ইচ্ছাকৃত ভাবে উৎসাহ দিয়েছে, তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। আর কমিশন যে সুপারিশ করেছে তার আইনি এক্তিয়ার নেই। ওই কমিটি ছিল শুধুমাত্র অনুসন্ধান কমিটি। তবে কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনের গাফিলতি সামনে এসেছে। এবং পুলিশের উপর অনাস্থা জানিয়েছেন মামলাকারীরা। তাই রাজ্যের পুলিশ বাদ দিলে এবং প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় এই তদন্ত সিবিআইকেই দিতে হয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে বেআইনি বা অস্বচ্ছ ভাবে কাজ করার অভিযোগ উঠলে আদালতের দরজা খোলা রয়েছে।’’ অন্য দিকে, বেঞ্চের বাকি বিচারপতিদের মতকেই স্বীকার করে নিজে কোনও মন্তব্য করেননি বিচারপতি তালুকদার।
রাজ্যে বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশ হয় ২ মে। তার পর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অশান্তির অভিযোগ ওঠে। তা নিয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয় কলকাতা হাই কোর্টে। তার পর ওই মামলার সঙ্গে যুক্ত হয় আরও ন’টি ভোট পরবর্তী অশান্তির মামলা। প্রথমে ডিভিশন বেঞ্চ, পরে ওই মামলাগুলির শুনানির জন্য বৃহত্তর বেঞ্চ তৈরি করে আদালত। ভোটের পর রাজ্যে যে হিংসার ঘটনা ঘটেছে, শুনানির প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে তেমনটাই মনে করেন বিচারপতিরা। যদিও প্রথমে রাজ্য তা স্বীকার করেনি। পরে আদালতের নির্দেশে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে অশান্তির অভিযোগ নথিবন্ধ করে। তাদের রিপোর্ট জমা হয় আদালতে। রিপোর্টের ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলে রাজ্য। রাজ্যের মতে, কমিশনের অনেক সদস্যের সঙ্গেই বিজেপি-র পূর্ব যোগ রয়েছে। ওই রিপোর্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই দাবি আরও জোরালো হয় রিপোর্টে ‘কুখ্যাত দুষ্কৃতী’দের তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পর। সেখানে দেখা যায়, শাসকদলের একাধিক নেতা-মন্ত্রীর নাম রয়েছে। বিতর্ক তৈরি হয় কমিশনের সুপারিশ নিয়েও। নিজেদের রিপোর্টে সিবিআই ও সিটের দ্বারা ওই সব ঘটনার তদন্তের সুপারিশ করেন কমিশনের আধিকারিকরা। যা তাঁদের এক্তিয়ারের বহির্ভূত বলে সওয়াল করেন সিব্বল। তবে বৃহস্পতিবার দেখা যায়, কমিশনের সেই রিপোর্টই প্রতিফলিত হয়েছে রায়ে।
উচ্চ আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে রাজ্য। এ নিয়ে আইনি পরামর্শও ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আইনজীবীদের একাংশ মনে করছেন, সাধারণত বেঞ্চের সব বিচারপতি এক মত হলে শীর্ষ আদালতেও ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাজ্যের একটি হাতিয়ারও রয়েছে। বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণকে হাতিয়ার করেই শীর্ষ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। এখন দেখার, রাজ্য সত্যিই সুপ্রিম কোর্টে যায় কি না। তবে তার আগেই এই মামলায় সেখানে ক্যাভিয়েট দাখিল করে রেখেছেন মামলাকারীদের আইনজীবী অনিন্দ্যসুন্দর দাস।