জলাজমিতে ভেড়ি তৈরি করে মাছ চাষ শুরু করেছে মৎস্য দফতর। ফাইল ছবি
মৎস্যপ্রেমী বাঙালির একটা বড় অংশ চেয়ে থাকতেন অন্ধ্রপ্রদেশের রুই-কাতলার দিকে। তবে সেই চাহিদা ক্রমেই কমছে। ভাটা আমদানিতেও। রাজ্যের মৎস্য দফতর সূত্রের খবর, অন্ধ্রের অনুকরণে বাংলার বেশির ভাগ জেলায় ময়না-মডেলে মাছ চাষ শুরু হয়েছে। সেই সূত্রে বড় রুই-কাতলার উৎপাদন বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গেও।
‘ময়না-মডেল’ কী? ২০১২ সালে পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না ব্লকের বিভিন্ন জমিতে মাছ চাষ শুরু হয় এবং সেটাই কালক্রমে হয়ে উঠেছে ‘ময়না-মডেল’। পরে অন্যান্য জেলারও জলাজমিতে ভেড়ি তৈরি করে মাছ চাষ শুরু করেছে মৎস্য দফতর। ওই দফতর সূত্রের খবর, ২০১৯-২০ সালে রাজ্যে মাছের উৎপাদন ছিল ১৭.৮২ লক্ষ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ সালে সেটা বেড়ে ১৭.৯৫ লক্ষ এবং ২০২১-২২ সালে ১৮.৪৩ লক্ষ মেট্রিক টন হয়েছে। মৎস্য দফতরের যুগ্ম অর্ধিকর্তা (সংখ্যাতত্ত্ব) পি কে জানা বলেন, ‘‘অন্ধ্রপ্রদেশের অনুকরণে আমাদের রাজ্যের বেশির ভাগ জেলায় বড় রুই-কাতলার চাষ শুরু হয়েছে। আগে যে-পরিমাণ রুই-কাতলা অন্ধ্র থেকে আসত, এখন সেটা কমেছে।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বছর পাঁচেক আগে পূর্ব মেদিনীপুরে এক প্রশাসনিক বৈঠকে ‘ময়না’-কে মডেল করে অন্যান্য জেলায় মাছ চাষে নজর দিতে বলেছিলেন মৎস্য দফতরকে। ওই দফতর সূত্রের খবর, প্রতি বছর অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ থেকে প্রায় দেড় লক্ষ মেট্রিক টন মাছ আসত বঙ্গে। তার মধ্যে ৮০ হাজার মেট্রিক টনই আসত অন্ধ্র থেকে। এখন ওই রাজ্য অন্ধ্র থেকে ৪০ হাজার মেট্রিক টন মাছ আসছে। ময়নায় প্রায় ছ’হাজার হেক্টর ভেড়ি বা জলাজমি জুড়ে রুই, কাতলা, মৃগেলের চাষ করছেন এক লক্ষ চাষি। ভেড়িগুলি রয়েছে ২০০ থেকে ৪৫০ একর জায়গা জুড়ে। মৎস্য দফতরের এক আধিকারিক জানান, ময়না-মডেলে চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। অন্ধ্রের বড় রুই-কাতলার চাহিদাও মিটছে।
মৎস্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ময়না ব্লকের যে-সব ভেড়িতে মাছ চাষ হচ্ছে, আগে সেগুলি ছিল কৃষিজমি। বন্যার ফলে জমিতে ফসল ফলিয়ে লাভ না-হওয়ায় মাছ চাষ শুরু হয়। বন্যার জল আটকাতে প্রশাসনের তরফে ভেড়ির চার পাশে পরিখা গড়া হয়েছে। দফতরের এক আধকারিক জানান, ময়নায় এখন বছরে প্রতি হেক্টরে ছ’টন মাছ চাষ হয়। প্রায় ৩৬ হাজার টন মাছ ময়না থেকে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে সঙ্গে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়েও যাচ্ছে।
অন্ধ্র থেকে মাছ আমদানি হ্রাসের আরও কিছু কারণ দেখছেন মৎস্য-বিশেষজ্ঞেরা। মৎস্য-বিশেষজ্ঞ বিজনকুমার মণ্ডলের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এখন অন্ধ্রের মাছচাষিরা বেশি লাভের ভেনামি চিংড়ি চাষের দিকে ঝুঁকছেন। ওখানে আগের মতো রুই-কাতলার চাষ আর হচ্ছে না। সেই সঙ্গে অন্ধ্র থেকে এ রাজ্যে গাড়িতে মাছ বহনের খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় অন্ধ্রের রুই-কাতলার চাহিদা কমেছে।’’ পুরুলিয়ার সিধো-কানহু-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অসীমকুমার নাথ বলেন, ‘‘অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে গাড়িতে বরফে ঢেকে আনা রুই-কাতলায় বিষাক্ত ফর্ম্যালিন মেশানো থাকে বলে অতীতে বহু বার খবর হয়েছে। তার জেরেও অনেক বাঙালি অন্ধ্রের রুই-কাতলা বর্জন করেছেন।’’