দীপন চক্রবর্তী এবং তিস্তা দাস।
মোবাইলের রিংটোন বদলে নিয়েছেন ডগমগ হবু কনে: ‘আজকাল পাঁও জমি পে নেহি পড়তে মেরে...!’ (‘আমার পা আজকাল মাটিতে পড়ছে না...!’)
মুখচোরা হবু বরও দারুণ রোম্যান্টিক। টোপর পরে বিয়ে করতে আসার প্রস্তুতিতে কোনও ফাঁক নেই।
আজ, সোমবার কনে তিস্তা দাস ও বর দীপন চক্রবর্তীর চার হাত এক হচ্ছে। পাত্রপাত্রী দু’জনেই রূপান্তরিত নারী ও পুরুষ। এমন বিয়ে এ রাজ্যে এই প্রথম। জন্মসূত্রে ‘সুশান্ত’ থেকে ‘তিস্তা’ হয়ে ওঠা মেয়ের পথ চলা খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর মতোই। বছর পনেরো আগে লিঙ্গান্তরের অস্ত্রোপচার সম্পূর্ণ হয়। কবি, বুটিক শিল্পী, সমাজকর্মী— বহুমুখী পরিচয়ের মেয়েটি ভালবাসার দ্বীপে নোঙর ফেলার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন।
অসমের লামডিংয়ে বেড়ে ওঠা দীপন, আগেকার দীপান্বিতার জীবনও নিজেকে নিয়ে অস্থিরতায় ভরপুর। নারী-শরীরে পুরুষ সত্তা মুক্তির পথ খুঁজছিল দীর্ঘদিন ধরে। বছর তিনেক আগে তিস্তার সঙ্গে পরিচয় বেশ নাটকীয় ভাবে। আগরপাড়ায় লিঙ্গান্তর সংক্রান্ত মুশকিল আসান সংস্থা চালান তিস্তারা। সেখানেই দেখা দু’জনের।
তখন দু’জনেই নিজেদের জীবনে ব্যর্থ সম্পর্কের বোঝা টানছেন। ছোট চুলের ‘চকলেট বয়’-গোছের ‘ছেলেটি’কে দেখে তিস্তার মনে হত, ‘ও তো বেশ কেয়ারিং।’ অস্ত্রোপচারের পরে কলকাতায় ওষুধ সংস্থায় কাজ করছিলেন দীপন। গত সরস্বতী পুজোতেও তিস্তাকে কথাটা বলতে না-পেরে হৃদয়ে রক্ত ঝরছিল তাঁর।
যৌন ঝোঁক অনুযায়ী দীপন এবং তিস্তা দু’জনেই যথাক্রমে জন্মগত নারী এবং পুরুষ লিঙ্গের প্রতি অনুরক্ত। তবু সব ব্যাকরণ ভেঙেচুরে গেল। সরস্বতী পুজোয় না-হোক, গত দোলে তিস্তার এক বান্ধবীর ভরসায় কথাটা বলেই ফেললেন দীপন। ‘আবার একটা সম্পর্ক...’ তখন দ্বিধাদীর্ণ তিস্তাও।
দীপন বলছিলেন, ‘‘আমার কাছে পৌরুষ মানে জেদাজেদি নয়। একটা মেয়েকে বোঝা। তাই অপেক্ষা করেছি।’’ সবুরে মেওয়া ফলেছে। ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে এতটা সংবেদনশীলতা কেউই আগে সঙ্গীর কাছে পাননি বলছেন চল্লিশের সীমানায় থাকা হবু বর-কনে। তিস্তার কথায়, ‘‘দীপনকে দেখে ভেবেছি, এক জন হয়ে ওঠা নারী হিসেবে আমিই বা কেন এক জন হয়ে ওঠা পুরুষকে গ্রহণ করতে পারব না!’’ ‘‘ভালবাসা আসলে লিঙ্গ নয়, দু’টি মনের ব্যাপার,’’ সম-উপলব্ধি এবং সমস্বর তিস্তা ও দীপনের।
২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টে এ দেশের যুগান্তকারী নালসা রায়ও বলেছিল এ কথা। লিঙ্গপরিচয় আসলে মানুষের মনে। সেই রায়ই প্রথম ব্যক্তির স্ব-লিঙ্গ নির্ধারণের অধিকার এবং তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত তথা রূপান্তরকামী, রূপান্তরিতদের মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কয়েক মাস আগে কেরলেও রূপান্তরিত একটি জুটি বিয়ে করেছে। তিস্তার মা চাইছিলেন, ‘‘ছেলেটা তো বেশ! একসঙ্গে না-থেকে বিয়েটা না-হয় সেরেই ফেলো!’’ অসমে দীপনের মা-বাবা অবশ্য এই বিয়েতে নিজেদের জড়াচ্ছেন না। তবে গড়িয়ায় বরের ভাড়ার ফ্ল্যাটের মালকিন বর পক্ষের অভিভাবকের ভূমিকায়। বুধবার, বৌভাতের দিন বিয়ের রেজিস্ট্রিও পাকা! ডানা মেলছে রূপান্তরিত নারী-পুরুষের ছকভাঙা যৌথতার উড়ান।