নেতাজি ইন্ডোরে অমিত শাহ। ছবি: পিটিআই।
লোকসভা নির্বাচনের আগে কলকাতায় এসে এই কথাই বলেছিলেন। ভোট মিটিয়ে নতুন করে ক্ষমতায় ফেরার মাস চারেক পরে আবার কলকাতায় এলেন অমিত শাহ এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) নিয়ে সেই একই কথা বললেন। তবে এ বার আরও জোর দিয়ে, আরও স্পষ্ট ব্যাখ্যা সহযোগে। যত রকম ভাবে কট্টর হিন্দুত্বের বার্তা দেওয়া সম্ভব, প্রায় তত রকম ভাবে সেই বার্তাও দিয়ে গেলেন বিজেপি সভাপতি।
প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে ভারতে চলে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টানদের প্রত্যেককে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়ার জন্য বিল পাশ করাতে চলেছে ভারত সরকার— বললেন অমিত শাহ। কিন্তু এক জন অনুপ্রবেশকারীকেও ভারতে থাকতে দেওয়া হবে না— বার্তা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি সভাপতির।
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের জনসভায় অমিত শাহ এনআরসি নিয়ে কী বলেন, সে দিকেই মঙ্গলবার তাকিয়ে ছিল গোটা বাংলা। ভোটের আগে এনআরসি নিয়ে সংশয় বা আতঙ্ক বাংলায় সে ভাবে তৈরি হয়নি। কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্য অসমে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হতেই পরিস্থিতি কিছুটা বদলে যায়। অসমের ১৯ লক্ষ বাসিন্দার নাম চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়ে। তার মধ্যে হিন্দু বাঙালির সংখ্যাও বিপুল। গোর্খা, বিহারি, মারোয়াড়ি-সহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীরও অনেকের নাম বাদ যায়। তার পরেই পশ্চিমবঙ্গে গরম হয় হাওয়া। এনআরসি নিয়ে কোথাও তৈরি হয়েছে সংশয়, কোথাও বিভ্রান্তি, কোথাও আতঙ্ক।
বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর অমিত শাহের সঙ্গে সব্যসাচী দত্ত। —নিজস্ব চিত্র।
আরও পড়ুন: কোনও শরণার্থীকে ভারত ছাড়তে হবে না, কোনও অনুপ্রবেশকারীকে ভারতে থাকতে দেব না: অমিত শাহ
তৃণমূল তো বটেই, বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসও এনআরসির বিরোধিতায় সরব হয়েছে। এনআরসি একটি বাঙালি বিরোধী পদক্ষেপ— এমন ব্যাখ্যাও দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তৃণমূলের কেউ কেউ। রাজ্য বিজেপি তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছিল। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ গত কয়েক দিনে একাধিক বার মুখ খুলেছিলেন। এ দেশে যে হিন্দুরা রয়েছেন বা এসেছেন, তাঁদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই— দিলীপ বার বার এই বার্তাই দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তবে অমিত শাহ ১ অক্টোবর কী বলেন, তা শোনার অপেক্ষায় ছিল বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বও।
বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি তথা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ দিন নিজের ভাষণে এনআরসি প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমি বাংলার জনতাকে সত্যিটা বলতে এসেছি।’’ কোনও রাখঢাক না করে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করেন তিনি। অমিত শাহ বলেন, ‘‘মমতাজি বলছেন, এনআরসি হলে লক্ষ লক্ষ হিন্দু শরণার্থীকে বাংলা ছেড়ে যেতে হবে। এর চেয়ে বড় কোনও মিথ্যা হয় না।’’ বিজেপি সভাপতির কথায়, ‘‘আমি সবার সামনে আশ্বস্ত করছি, সব শরণার্থীকে আশ্বস্ত করছি, যাঁরা এ দেশে চলে এসেছেন, তাঁদের কাউকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করা হবে না।’’ এনআরসি নিয়ে তৃণমূল যা বলছে, তা ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে অমিত শাহ এ দিন দাবি করেন। তাঁর কথায়, ‘‘এই মিথ্যাটা ছড়ানো হচ্ছে বাংলার মানুষকে উস্কে দেওয়ার জন্য।’’
এনআরসি প্রসঙ্গ ছুঁয়েই অমিত শাহ প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছেন, এমন কিন্তু নয়। তাঁর ভাষণের অর্ধেকটাই এ দিন ছিল এনআরসি এবং সিএবি প্রসঙ্গে। ভোটের আগে যতটা বলেছিলেন এই প্রসঙ্গে, এ দিন তার চেয়ে অনেক বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। শাহ বলেন, ‘‘এনআরসি তৈরি করার আগে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনছে ভারত সরকার। ভারতে যত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান এসেছেন, তাঁদের সবাইকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে। চিরকালের জন্য দিয়ে দেওয়া হবে।’’
প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে ভারতে চলে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দিতে ওই বিল সংসদে পেশ করা হয়েছিল প্রথম মোদী সরকারের আমলেই— মনে করিয়ে দেন দ্বিতীয় মোদী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার পরে সেই প্রসঙ্গেই নিশানা করেন তৃণমূলকে। অমিত শাহ বলেন, ‘‘নাগরিকত্ব সংশোধন বিল যখন আনা হয়েছিল, তৃণমূল রাজ্যসভা চলতে দেয়নি। বিলটাকে পাশ হতে দেয়নি। তাই মতুয়া ভাইয়েরা-সহ অন্য শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া যায়নি।’’ শাহের আশ্বাস, ‘‘এখন পরিস্থিতি বদলেছে। এখন আর আটকাতে পারবে না।’’
রাজ্য বিজেপি নেতাদের সঙ্গে অমিত শাহ। —নিজস্ব চিত্র।
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম থেকে এ দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সতর্কবার্তাও উচ্চারণ করে গিয়েছেন অমিত শাহ। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে যাঁরা ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের ‘প্ররোচিত’ করার রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। মমতার উদ্দেশে শাহের বার্তা, ‘‘যাঁরা নিজেদের ভূমিতে ফিরেছেন, সন্ত্রাসের শিকার হয়ে এসেছেন, তাঁদের নিয়ে মজা করবেন না, দীর্ঘশ্বাস লাগবে।’’
বাংলার বিজেপি কর্মীদের উদ্দেশে দলের সর্বভারতীয় সভাপতির বার্তা— বাড়ি বাড়ি গিয়ে এনআরসির বিষয়ে বোঝাতে হবে। কোনও হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টানকে ভারত ছেড়ে যেতে হবে না, সবাইকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে, তার পরে এনআরসি হবে— এই কথাই বোঝাতে বলেছেন অমিত শাহ।
‘অনুপ্রবেশকারী’ তত্ত্বে অবশ্য অটলই থেকেছেন অমিত শাহ। তিনি বলেন, ‘‘একটাও অনুপ্রবেশকারীকে ভারতের মাটিতে আমরা থাকতে দেব না। এক জনকেও থাকতে দেব না।’’ দেশের সুরক্ষার জন্যই অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ানো দরকার বলে তিনি এ দিন মন্তব্য করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও শরণার্থীকে যেতে হবে না, কিন্তু কোনও অনুপ্রবেশকারীকে থাকতে দেব না।’’
আরও পড়ুন: ‘অব কি বার... ’ ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে, বললেন বিদেশমন্ত্রী ।। মোদীকে কূটনীতি শেখান, কটাক্ষ রাহুলের
তৃণমূলনেত্রীকে কটাক্ষ করে এ দিন অমিত শাহ প্রশ্ন তোলেন— বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন কেন মমতা নিজেই অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ানোর দাবিতে সরব হয়েছিলেন? এখন সেই অনুপ্রবেশকারীরাই মমতার ভোটব্যাঙ্কে পরিণত হয়েছে, তাই তিনি এনআরসি হতে দেবেন না বলছেন— মন্তব্য বিজেপি সভাপতির।
বিজেপি এ বারের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ১৮ আসন পাওয়ায় পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে বলে এ দিন অমিত শাহ দাবি করেন। প্রথমে কপট অনুযোগের ভঙ্গিতে বিজেপি কর্মীদের তিনি বলেন, ‘‘আপনারা মমতাজিকে বেশি আসন দিয়েছেন। আমাদের দিয়েছেন ১৮টা।’’ তার পরেই বলেন, ‘‘বিজেপির ১৮টা আসন পাওয়ার পরিণাম দেখুন। আগে দুর্গাপুজোর বিসর্জনের জন্য আদালতে যেতে হচ্ছিল। এ বার আর কারও হিম্মত হচ্ছে না বাধা দেওয়ার। বসন্ত পঞ্চমী দেখুন, কারও হিম্মত হচ্ছে না সরস্বতী পুজোয় বাধা দেওয়ার। কারও হিম্মত নেই রামনবমীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার।’’
বিজেপির ভোট বাড়লেই হিন্দুদের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়— এই রকম বার্তাই এ দিন বার বার দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অমিত শাহ। বিজেপির আর কোন সর্বভারতীয় নেতাকে এর আগে বাংলায় এসে এত কট্টর হিন্দুত্বের কণ্ঠস্বরে কথা বলতে শোনা গিয়েছে, মনে করা সত্যিই কঠিন।
এনআরসি নিয়ে অমিত শাহ যা বলেছেন এবং যে ভাবে কট্টর হিন্দুত্বের বাণী দিয়ে গিয়েছেন, তার জবাব রাজ্যের শাসক দলের পক্ষ থেকে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। এনআরসি নিয়ে অমিত শাহ যা বলে গেলেন, তাতে তিনি নিজেই আতঙ্কিত বলে অমিত মিত্র এ দিন মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি তো যশোহরের লোক, পূর্ব পাকিস্তান ছিল। এখন নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বললে কী কাগজ দেব?’’ পুজোর সময়ে অমিত শাহ বাংলায় এসে যা বললেন, তাতে আতঙ্ক আরও বেড়ে গেল বলে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী এ দিন মন্তব্য করেছেন।
স্টেডিয়ামে বিজেপি সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তৃতা করছেন অমিত শাহ। —নিজস্ব চিত্র।
আরও পড়ুন: রাজীবের কাছে ‘হার’ সব দিকেই, সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সিবিআই
‘‘বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করেছেন’’, মন্তব্য অমিত মিত্রের। অমিত শাহকে আক্রমণ করে অমিত মিত্র বলেন, ‘‘তিনি ধর্মের নাম করে বলছেন, এনআরসি হলে হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ ধর্মাবলম্বীদের কিছু হবে না। শুধু একটা ধর্মের নাম ছেড়ে যাচ্ছেন।’’ অন্য দেশ থেকে ভারতে আাসা সব ধর্মের লোকজনকে আশ্রয় দেওয়া হবে, শুধু একটা ধর্মের লোকজনকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে— এ কথা বলার অধিকার কারও রয়েছেন কি না, সেই প্রশ্নও এ দিন তোলেন অমিত মিত্র। তাঁর কথায়, ‘‘সংবিধান কি এই কথা বলার অনুমতি দেয়?’’
অমিত মিত্রের হুঁশিয়ারি, ‘‘আজ যে বক্তব্য অমিত শাহ রেখেছেন, বাংলার মানুষ তাঁর জবাব দেবেন।’’ আর অমিত শাহের বক্তব্য— যাঁরা প্রশ্ন করেন বাংলার সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক নিয়ে, তাঁরাই এ বার জবাব পাবেন। সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করে অমিত শাহের মন্তব্য, ‘‘মমতাজি আপনি ইতিহাস পড়েননি। স্বাধীনতার পর পুরো বাংলা পাকিস্তানে যেতে চলেছিল। আমাদের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বিরোধিতা করেছিলেন, বিদ্রোহ করেছিলেন। তাঁর বিদ্রোহের কারণেই পশ্চিমবঙ্গ আজ ভারতের অংশ।’’
জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করার জন্য এই বাংলার শ্যামাপ্রসাদই আন্দোলন শুরু করেছিলেন— মনে করিয়ে দেন অমিত শাহ। তার পরে বলেন, বাংলা মোদী সরকারকে ১৮টা আসনে জেতানোর সঙ্গে সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদের স্বপ্ন পূরণ করে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। শ্যামাপ্রসাদের রাজ্যে বিজেপির সরকার প্রতিষ্ঠিত হবেই, দাবি বিজেপি সভাপতির।