এখনও দলের অস্বস্তি হয়ে রইলেন সব্যসাচী দত্ত। —নিজস্ব চিত্র।
আরও চড়ল সংঘাতের সুর। রবিবার বিধাননগরের কাউন্সিলদের সঙ্গে বৈঠক সেরে তৃণমূল ভবন থেকে বেরনোর সময়েও মেয়র সব্যসাচী দত্ত সম্পর্কে রেখেঢেকে মন্তব্য করেছিলেন ফিরহাদ হাকিম। কিন্তু সোমবার সব্যসাচীকে ‘বেইমান, মিরজাফর’ বলে আক্রমণ করলেন ফিরহাদ। ‘‘যিনি এ সব বলছেন, তিনি নিজে কী, এক বার ভেবে দেখুন,’’ পাল্টা বললেন সব্যসাচীও। বিধাননগরের পুরভবনে ঢুকতে বারণ করা হয়েছে সব্যসাচীকে, রবিবার এমনই জানা গিয়েছিল তৃণমূল সূত্রে। কিন্তু সোমবার সব্যসাচীর পাল্টা চ্যালেঞ্জ— আজই পুরসভায় যাব, কারও ক্ষমতা থাকলে আমাকে আটকান।
বিজেপি নেতা মুকুল রায় এবং বিধাননগরের মেয়র তথা রাজারহাট-নিউটাউনের তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত রবিবার রাতে এক ফ্রেমে ধরা দেওয়ার পর থেকেই তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র হয়েছে। কয়েক মাস আগে সব্যসাচীর বাড়িতে লুচি-আলুর দম খেতে গিয়েছিলেন মুকুল। তখনও তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল তৃণমূলে। সব্যসাচীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য বিধাননগর কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন ফিরহাদ হাকিম, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকরা। শেষ পর্যন্ত সব্যসাচীকে সরানো হয়নি। বৈঠক শেষে সাংবাদিক সম্মেলন করে ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছিলেন, সব্যসাচী ভুল করেছেন এবং এমন ভুল যাতে আর না করেন, সে বার্তা কঠোর ভাবেই তাঁকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিধাননগরের মেয়র সে দিন ফিরহাদের পাশে দাঁড়িয়ে ফিরহাদের কথাতে সায় দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু দ্রুতই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, গতিপথ তিনি বদলাননি। মাঝেমধ্যেই নানা কার্যকলাপে এবং মন্তব্যে তৃণমূলের অস্বস্তি ক্রমশ বাড়াচ্ছিলেন তিনি। কয়েক দিন আগে বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীদের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়ে এবং সে মঞ্চ থেকে তৃণমূলেরই সরকারকে সব্যসাচী আক্রমণ করার পরে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু কোনও অসন্তোষের পরোয়া না করে সব্যসাচী জানিয়ে দেন, দলের যদি মনে হয় তিনি শৃঙ্খলাভঙ্গ করছেন, তা হলে দল তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক।
আরও পড়ুন: সব্যসাচীতে অনাস্থা দলের, তবু পথ খুঁজতে হিসেবি পা তৃণমূলের
এর পর থেকেই সব্যসাচীর বিষয়ে হেস্তনেস্ত করে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল। রবিবার সব্যসাচী বাদে বিধাননগরের অন্য সব তৃণমূল কাউন্সিলরকে তৃণমূল ভবনে ডেকেছিলেন ফিরহাদ হাকিম। সে বৈঠকে ৩৯ জন তৃণমূল কাউন্সিলরের মধ্যে ৩৬ জনই উপস্থিত ছিলেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, সব কাউন্সিলরই সব্যসাচীকে সরানোর পক্ষে মত দেন ওই বৈঠকে। বৈঠক সেরে বেরনোর পথে ফিরহাদ জানিয়ে যান, কাউন্সিলরদের মতামত তিনি দলনেত্রীকে জানাবেন এবং যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দলনেত্রীই নেবেন। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্তের কথা সোমবার বিকেল পর্যন্ত ঘোষিত হয়নি। তৃণমূল সূত্রে শুধু জানা গিয়েছে, মেয়র পদ থেকে সব্যসাচীকে এখনই সরানো যাক বা না যাক, তাঁকে অকেজো করে দেওয়া হচ্ছে। এখন থেকে সব্যসাচী আর পুরসভার কাজ দেখবেন না, সব সামলাবেন ডেপুটি মেয়র তাপস চট্টোপাধ্যায়— ফিরহাদ হাকিম এই রকমই নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। তবে এই রকম কোনও নির্দেশের বিষয়ে তৃণমূলের তরফে কোনও স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়নি। সব্যসাচী দত্তরও দাবি, তাঁকে কেউ কিছু বলেননি এবং মেয়র হিসেবে তিনিই এখনও বিধাননগরের পুর প্রশাসন দেখভাল করছেন।
তৃণমূল নেতৃত্ব এবং সব্যসাচী দত্তর মধ্যে সম্পর্কের এই টানাপড়েনে বিধাননগরের পুর প্রশাসনে এখন সংশয়ের পরিবেশ। এক দল কাউন্সিলরকে পাশে বসিয়ে ডেপুটি মেয়র তাপস চট্টোপাধ্যায় এ দিনই দাবি করেছেন যে, পুর পরিষেবা এত দিন ঠিকমতো মিলছিল না। তিনি একা নন, কাউন্সিলরদের সঙ্গে নিয়ে ‘টিম’ হিসেবে আপাতত বিধাননগর পুর এলাকার কাজ দেখভাল করবেন— এমন মন্তব্যও করেছেন তাপস। আর অন্য দিকে মেয়রকে পুরসভায় ঢুকতে বারণ করা হয়েছে বলে যে কথা তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে, তা নস্যাৎ করে সব্যসাচী সোমবার সকাল থেকে বার বার জানিয়েছেন যে তিনি পুরসভায় ঢুকবেন। কারও ক্ষমতা থাকলে তাঁকে আটকে দেখাক, এমন চ্যালেঞ্জও ছুড়েছেন। কথা মতো এ দিন বিকেলে বিধাননগর পুরসভায় সব্যসাচী দত্ত ঢুকেওছেন এবং মেয়রের চেয়ারে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। এতেই শেষ নয়, সব্যসাচী বলেছেন, ‘‘তাপস চট্টোপাধ্যায়কে যে এখনও ডেপুটি মেয়র পদে বসিয়ে রেখেছি সেটা আমার সৌজন্য।’’
তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব এখনও সব্যসাচী প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করেননি। দলের তরফে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও এখনও হয়নি। কিন্তু রবিবারের সংযমী মন্তব্যের অবস্থান থেকে সরে এসে রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম সোমবার তীব্র আক্রমণ করেছেন সব্যসাচীকে। তিনি এ দিন বলেছেন, ‘‘সব্যসাচী যেটা করছেন, সেটা দলের পক্ষে অত্যন্ত অস্বস্তিকর। দলে থেকে কেউ এই সব করবে, সেটা সহ্য করা যায় না। তাই নিশ্চিত ভাবে আমি শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কাছে আর্জি জানাব কঠোর পদক্ষেপ করা হোক।’’ বিধাননগরের মেয়রকে কটাক্ষ করে রাজ্যের পুরমন্ত্রীর মন্তব্য: ‘‘দল এ রকম হয়ে যায়নি যে, সব্যসাচী দলের জন্য অপরিহার্য।’’
মুকুল রায়ের সঙ্গে আবার সব্যসাচীর এক ফ্রেমে দেখা দেওয়া এবং একসঙ্গে নৈশভোজ সারাকে যে তৃণমূল নেতৃত্ব একেবারেই ভাল চোখে দেখছেন না, তা ফিরহাদ সোমবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘বার বার যিনি দলকে ভাঙাচ্ছেন, তাঁর সঙ্গে বসে রয়েছে। যাওয়ার হয় চলে যাও। দু’নৌকোয় পা রেখে তো তুমি ডুবে যাবে! কিসের জন্য অপেক্ষা করছ?’’ সব্যসাচীকে অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবং তিনি নিজে সব্যসাচী এবং দলীয় নেতৃত্বের মধ্যে সেতু হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন— মন্তব্য ফিরহাদের। তিনি জানান যে, সব্যসাচীকে নিয়ে তিনি হতাশ। ফিরহাদের কথায়: ‘‘ওর যদি শুভবুদ্ধি থাকে, সম্মান যদি থাকে, ও ছেড়ে দিক।’’ বিধাননগরের মেয়র তথা রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ককে তীব্র আক্রমণ করে রাজ্যের পুরমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়রের মন্তব্য, ‘‘মুকুল রায়ের পাশে বসে সব্যসাচী প্রমাণ করছেন যে, তিনি বেইমান, তিনি মিরজাফর।’’
সোমবার বিধাননগর পুরভবনে কাউন্সিলরদের নিয়ে বৈঠকে তাপস চট্টোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
আরও পড়ুন: পুলিশ হাসপাতাল এ বার সাধারণের জন্য, নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর, দেখে এলেন আহত কনস্টেবলকে
ফিরহাদের এই মন্তব্য অবশ্য হজম করতে চাননি সব্যসাচী দত্ত। পাল্টা আক্রমণে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘কারও সঙ্গে কথা বলা যদি বেইমানি হয়, তা হলে যিনি আমাকে বলছেন, তিনি নিজে ভেবে দেখুন, তিনি কী।’’ মুকুল রায়ের সঙ্গে দেখা করা বা নৈশভোজ সারার মধ্যে কোনও অন্যায় দেখছেন না সব্যসাচী। মুকুল রায় ‘দাদা’ হিসেবে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন বলে সব্যসাচী এ দিন দাবি করেন। সারা দিন তাঁকে নিয়ে মিডিয়ায় যা দেখা গিয়েছে, তাতে উদ্বিগ্ন হয়েই মুকুল রায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন এবং পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন বলে সব্যসাচী জানান।
কিন্তু দলের সঙ্গে তিক্ততা যখন তুঙ্গে, যখন ফিরহাদ হাকিম স্পষ্ট বলছেন সব্যসাচী চাইলে দল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারেন, তখনও সব্যসাচী অবস্থান স্পষ্ট করছেন না কেন? মেয়রকে অকেজো করতে ডেপুটি মেয়রকে কাজ চালানোর নির্দেশ যখন দিয়ে দিচ্ছেন পুরমন্ত্রী, তখনও কি তাঁর মনে হচ্ছে না যে, তাঁর প্রতি দলের আর আস্থা নেই? সব্যসাচীর জবাব: ‘‘দল তা হলে লিখিত জানাক। আমার একটা সদস্য পদ তো অন্তত রয়েছে। লিখিত ভাবে জানিয়ে দিক যে, সেটা আর নেই। তার প
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।