‘এখন দেশ ছাড়তে হলে কোথায় যাব বলেন দেখি!’

খান দশেক সিঁড়ি ভেঙে দেড়তলায় দশ বাই দশ ঘর, ডাক্তারবাবুর চেম্বার। লম্বাটে বারান্দায় সার দিয়ে বেঞ্চিতে উসখুস করা ভিড়টা ভাদ্রের গরমে ঘামছে।

Advertisement

সুজাউদ্দিন বিশ্বাস

ডোমকল শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:২৯
Share:

এনআরসি-আতঙ্ক: ডোমকলে ডাক্তারের চেম্বারে গ্রামবাসীরা। ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম

মলিন পাজামা, কনুই ফাঁসা পাঞ্জাবির হাতা গোটানো। ডাক্তারের হাত ধরে মধ্য চল্লিশ মানুষটা হাউ হাউ করে কাঁদছেন— ‘‘ও ডাক্তার বাঁচান গো আমাদের, গত বন্যায় দলিল-টলিল সব ভেসে গিয়েছে, ভোটার-আধার, দু’টো কার্ডেই নামে ভুল... এখন দেশ ছাড়তে হলে কোথায় যাব বলেন দেখি!’’

Advertisement

খান দশেক সিঁড়ি ভেঙে দেড়তলায় দশ বাই দশ ঘর, ডাক্তারবাবুর চেম্বার। লম্বাটে বারান্দায় সার দিয়ে বেঞ্চিতে উসখুস করা ভিড়টা ভাদ্রের গরমে ঘামছে। ভারী পর্দা উজিয়ে রায়পুরের সালাম শেখের কান্না ছড়িয়ে রয়েছে সেই খোলা বারান্দায়।

মুর্শিদাবাদের প্রান্তিক শহর ডোমকলের হসপিটাল মোড়ের কাছে মনোবিদ সেলিম মালিকের চেম্বারে সকাল-সন্ধে এমনই চাক বাঁধছে এনআরসি’র (জাতীয় নাগরিকপঞ্জি) ভয় আর হাহাকার। পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলেই কখনও বলিহারপুরের সাজিমা বিবি, কখনও টেঁয়া গ্রামের সাজ্জাদ হোসেনের চাপা কান্না আর গভীর দীর্ঘশ্বাস। ভয়ের নাম এনআরসি!

Advertisement

সপ্তাহে খান দশেক রোগী দেখে অভ্যস্ত সেলিম মালিক এখন দিনে জনা পঁচিশ ‘এনআরসি জুজু’ আক্রান্ত মানুষকে সামলে স্বস্তিতে এক কাপ চা খাওয়ার সময় পাচ্ছেন না। বলছেন, ‘‘কী হল বলুন দেখি, এ তো গণ-ভয়!’’

প্রায় নিভু নিভু সেই চেম্বারে এখন একের জায়গায় তিন জন সহকর্মী, টেবিল পাতা রিসেপশনে রোগীদের পথ্য বোঝাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন মাঝবয়সি মহিলা। একদা বহরমপুর মেন্টাল হাসপাতালের ওই মনোবিদের চেম্বারে এখন এনআরসি-আতঙ্কে থাকা

গ্রামবাসীদের কেউ কাঁদছেন, কেউ বা ডাক্তারের চেম্বারে ছটফট করতে করতে বলছেন, ‘‘না গো, পাইরব নাই, ভিটে-মাটি ছাইর‌্যা চলি যাওয়া যায়!’’

অসমের পরে বাকি দেশে এনআরসি হবেই, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি নেতাদের এমন হুঙ্কারের পর ভয়ের ঘন ছায়া পড়েছে সীমান্তের গাঁ-গঞ্জে। দিন কয়েক আগে ভোটার তালিকায় নাম সংশোধন করতে না পেরে ডোমকলের শিবনগর গ্রামের যুবক মিলন মণ্ডলের আত্মহনন নিয়ে ঢেউ উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আশপাশের গ্রামে চায়ের দোকান থেকে সান্ধ্য-মাচায়— তর্ক ছুটছে মিলন আর এনআরসি। সীমান্তের সেই জনপদ জুড়ে যেন অজস্র মিলনের হাহাকার! সেলিম মালিক বলছেন, ‘‘এ এক ধরনের অ্যাংজ়াইটি ডিসর্ডার। তবে তার ছোঁয়াচ বড় সাঙ্ঘাতিক জানেন। ভয় ছড়ালে গ্রামের পর গ্রাম তাতে আক্রান্ত হতে পারে। সেই তীব্র ভয় সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে অনেককে আত্মহননের দিকেও ঠেলে দিতে পারে।’’ ডোমকলের বিডিও পার্থ মণ্ডল বলছেন, ‘‘এনআরসি’র ভয় যেন গণ হিস্টিরিয়ার চেহারা নিচ্ছে! আমরা প্রতিটি পঞ্চায়েত প্রধান, এমনকি স্কুল শিক্ষকদেরও বলেছি, বিভ্রান্তি কাটাতে মানুষকে বোঝান, অভয় দিন।’’

টেঁয়া রামপুরের বাসিন্দা আসরফ আলি জড়সড় হয়ে বসে আছেন ডাক্তারের চেম্বারে। বলছেন, ‘‘সাত পুরুষের ভিটে ছাড়ার ভয় কি আর মুখের কথায় কাটে বাবু!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement