দাম ও দর শেঠ
TMC

WBSSC Scam: ১৫ কোটি টাকা ফিরিয়েছি, বললেন নান্টুর বাবা

পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পরে এই সব টাকা তোলার ‘এজেন্ট’দেরও গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।

Advertisement

গোপাল পাত্র, জয়ন্ত সেন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২২ ০৬:৩২
Share:

ফাইল চিত্র।

শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা নগদে উদ্ধার হয়েছে। সেই সূত্রেই সামনে আসছে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে থাকা বহু শাসক-ঘনিষ্ঠের নাম। অভিযোগ, চাকরির নাম করে দীর্ঘ দিন ধরে টাকা তোলার চক্র চালাচ্ছে এরা। কেউ চাকরি পেয়েছেন, কেউ পাননি। কিন্তু চক্রের ভাগীদাররা ফুলেফেঁপে উঠেছে।

Advertisement

জেলায় জেলায় ছড়িয়ে থাকা বেসরকারি ডিএলএড, বিএড কলেজের মালিকরাও একই কাজ করে গিয়েছেন সন্তর্পণে। পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরে নিহত তৃণমূল নেতা নান্টু প্রধানের বিএড কলেজ থেকেও এই কারবার চলত বলে অভিযোগ। অভিযোগ, পার্থ-ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলেই নান্টু অনেককে শিক্ষকতার চাকরি পাইয়ে দিয়েছিলেন। তবে অনেককে পারেনওনি। তাই নান্টুর মৃত্যুর পরে পাওনাদারদের ভিড় বেড়েছিল। টাকা দিয়েও চাকরি পাননি এমন ৬০০ জনকে নান্টুর বাবা চাঁদহরি প্রধান টাকা ফিরিয়েছেন বলে নিজেই জানিয়েছেন। তৃণমূল পরিচালিত মহম্মদপুর-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য চাঁদহরি প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত ১৫ কোটি টাকা ফিরিয়েছি৷ আরও কিছু টাকা ফেরানো বাকি আছে।’’

পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পরে এই সব টাকা তোলার ‘এজেন্ট’দেরও গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তবে মালদহে নিয়োগ-অভিযোগের বৃত্তে শুভেন্দুর নামও চর্চায় রয়েছে। অভিযোগ উঠেছিল, সেই নিয়োগে মেদিনীপুরের বহু পরীক্ষার্থী মালদহ থেকে ফর্ম পূরণ করেছিলেন (২০১৪ সালে জেলাভিত্তিক নিয়োগেরই নির্দেশ ছিল, বর্তমানে সে নিয়ম অবশ্য নেই) এবং মালদহে চাকরিও পেয়ে গিয়েছিলেন। এ-ও অভিযোগ, শুভেন্দুর তৎকালীন অনুগামী মেদিনীপুরের তৃণমূল নেতারাই সবটা সামলেছিলেন। ২০১৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের সময়ে শুভেন্দু ছিলেন মালদহে তৃণমূলের পর্যবেক্ষক।

Advertisement

পূর্ব মেদিনীপুরেও অতনু গুছাইতদের মতো যাঁদের বিরুদ্ধে এখন পার্থ-ঘনিষ্ঠ হিসেবে টাকা তোলার অভিযোগ দায়ের হচ্ছে, তাঁরা এক সময় ‘শুভেন্দুর লোক’ ছিলেন বলেই অভিযোগ। কোলাঘাটের প্রাক্তন তৃণমূল কর্মাধ্যক্ষ অতনুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। তিনি সপরিবার পলাতক। ঝাড়গ্রামের বাঁধগোড়ায় অতনুর মস্ত খামারবাড়িও চর্চায়। বাঁধগোড়া পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান বিপ্লব মান্নাই বলছেন, ‘‘খামারের মালিক শুভেন্দু অধিকারীর ঘনিষ্ঠ বলেই জানতাম।’’

শুভেন্দুর পাল্টা চ্যালেঞ্জ, ‘‘সরকারে থাকার সময় অন্যায় ভাবে কাউকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছি এমন অভিযোগ থাকলে প্রমাণ করে দেখান। কোনও সুযোগ কেন, একটা ব্ল্যাকবোর্ডও অন্যায় ভাবে নিইনি। অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব।’’ তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের পাল্টা, ‘‘যে সময়ের নিয়োগ নিয়ে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সে সময় শুভেন্দু তৃণমূলে এবং সরকারে। তখন এ সব কথা বলেননি। আর ওর নাম তো সিবিআইয়ের এফআইআর-এ রয়েছে৷ ও বিজেপিতে গিয়ে রক্ষাকবচ নিয়ে এ সব কথা বলছে।’’

প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর নাম তো বার বার সামনে আসছে এই কারবারে। মানিক ভট্টাচার্য যখন পর্ষদ চেয়ারম্যান, তখন মালদহ জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের সভাপতি ছিলেন ইংরেজবাজারের কাউন্সিলর আশিস কুণ্ডু। অভিযোগ, সে সময় পর্ষদ থেকে সরাসরি পৃথক কয়েকটি নিয়োগের তালিকা এসেছিল। তাতে মালদহের বাইরের জেলার প্রার্থীদের নাম ছিল। অভিযোগ, আশিসের সময়ে তাঁদের নিয়োগ করা হয় মালদহের বিভিন্ন স্কুলে। আশিসের সঙ্গে পার্থের ‘সখ্য’ এবং মন্ত্রীকে ‘দামি ঘড়ি উপহার’ দেওয়া নিয়েও জোর চর্চা রয়েছে। আশিস কুণ্ডু বলেন, ‘‘আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’ তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, আশিস জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান থাকাকালীন কোনও নিয়োগ প্রাথমিকে হয়নি এবং তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও নেই।

এখন প্রশ্ন হল, টোপ তো এসেছে। কিন্তু চাকরিপ্রার্থীদের অনেকেই সেই ফাঁদে পা দিলেন কেন? বাঁকা পথে সহজে চাকরি পাওয়ার প্রবণতা, নেতা বা নেতা-ঘনিষ্ঠের পরিবার-পরিজনকে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি বাদ দিলে, চাকরিপ্রার্থীদের অনেকেই তো জমিজিরেত বিক্রি করে, ধার করে টাকা জোগাড় করেছেন। সম্প্রতি ইউটিউবে একটি সিরিজ়ে স্কুলে রাজনৈতিক প্রভাবে বদলি এবং টাকার খেলার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘শিক্ষকের বদলির ক্ষেত্রে টাকা লেনদেনের যে বিষয়টা দেখানো হয়েছে, তা আমার পরিচিত এবং বন্ধুবান্ধবদের সূত্রে জেনেছি। অনেকেই এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। আমার বাড়ি বহরমপুরে। আদি বাড়ি তেহট্টে। আমি দেখেছি, এমন কেউ কেউ রয়েছেন, যাঁরা বহু দূরে চাকরি করেন, বাড়ির কাছে স্কুলে ফিরতে মরিয়া। প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে স্কুল। যাতায়াতে ঘণ্টাতিনেক সময় লেগে যায়। সেই ক্ষেত্রে টাকা দিয়ে বদলি নেওয়া হয়েছে।’’

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক অভিজিৎ কুণ্ডুর ব্যাখ্যা, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে মানুষ আর প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করছে না। নিয়ম মেনে চাকরি পাবে— এই ভরসাটাই নেই। অনেকে রাজ্যের বাইরে চলে যাচ্ছেন। যাঁরা যেতে চান না অথবা বাইরে কিছু পাচ্ছেন না, তাঁরা টাকা দিয়ে চাকরি কিনছেন। তাঁরা জানেন, কোনও দাদা ধরতেই হবে।’’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মহালয়া চট্টোপাধ্যায়েরও মত, ‘‘নব্বইয়ের দশকে স্কুল সার্ভিস কমিশন তৈরি হয়েছিল যাতে স্বচ্ছ ভাবে স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে দুর্নীতির এই পর্যায়ে বিষয়টা পৌঁছেছে। সকলেই বুঝে গিয়েছেন, টাকা যদি না দেওয়া হয়, নিয়োগ সম্ভব নয়।’’ যদিও অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার বলেন, ‘‘সরকারি চাকরির সুযোগসুবিধা পাওয়ার লোভে বহু লোক মোটা টাকা খরচ করেও চাকরি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। ভাল বেতন, চাকরির স্থায়িত্ব, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির নিশ্চয়তা, পেনশন ইত্যাদি সুবিধাগুলির জন্য সরকারি চাকরি পেতে টাকা খরচ করতে কার্পণ্য করেন না চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ। তাঁরা এটাও অঙ্ক কষে নেন যে, চাকরি পেতে যে টাকা দিচ্ছেন, অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তা উঠে আসবে।’’

আর প্রদীপ্তের সংযোজন, ‘‘ঘুষ বা দুর্নীতি এখন সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রেই চারিয়ে গিয়েছে। ছোটখাটো কাজের ক্ষেত্রেও দেখবেন, ৫০ টাকা দিলে এক দিনেই কাজটা হয়ে যাবে। টাকা না দিলে হয়তো ১৫ দিনেও তা হচ্ছে না। এখন মানুষও সেটা মেনে নিয়েছেন।’’

সহ প্রতিবেদন: অভিজিৎ সাহা

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement