সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনে ভর করেই এই রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার আশ্বস্ত করেন, জোর করে চাষির জমি নেওয়া হবে না। কেন্দ্রের জমি বিলেরও ঘোর বিরোধী মমতা। অথচ সিঙ্গুরের জেলা হুগলিতেই জোর করে জমি নেওয়ার অভিযোগ তুললেন তৃণমূল সমর্থক চাষিরা।
অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছে একটি সেতুর আপ্রোচ রোড গড়ার জন্য জমি অধিগ্রহণ ঘিরে জটিলতা। পুরশুড়ার বড়দিগরুই এলাকায় মুণ্ডেশ্বরী নদীর উপরে রাজ্য পূর্ত দফতরের আওতায় একটি সেতু তৈরি হয়েছে ২০১৩-য়। তার অ্যাপ্রোচ রোডের জায়গা নিয়েই সমস্যা। অল্প কিছু চাষি জমি বাবদ টাকা নিলেও প্রায় তিনশো
জন সরকারি চেক নেননি। তাঁদের আপত্তি ছিল সরকার নির্ধারিত দাম নিয়ে। কিন্তু তা ধোপে টেঁকেনি। চাষিদের দাবি, আদালত প্রশাসনকে তাঁদের সঙ্গে সমঝোতা রেখে কাজ করতে বললেও তাঁরা কথা বলার সুযোগ পাননি। প্রতি বারই জেলাশাসকের অফিস থেকে ডাকে চিঠি এসেছে শুনানির নির্দিষ্ট তারিখের পরে।
মাস কয়েক আগে চণ্ডীতলায় প্রশাসনিক বৈঠকে এসে মুখ্যমন্ত্রী ওই সেতুটি চালু না হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেন। তখনই তিনি স্থানীয় নেতাদের নির্দেশ দেন, যাতে সেতুটি দ্রুত চালু করা যায় সেই ব্যাপারে পদক্ষেপ করতে হবে। কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য পুরশুড়ার তৃণমূল নেতৃত্বকেই দায়ী করেছেন ওই এলাকার চাষিরা। তাঁদের কেউ কেউ জমি নেওয়ার জন্য চাষিদের হুমকি দিয়েছেন, মারধরও করেছেন বলে অভিযোগ।
ওই চাষিদের অনেকেরই আক্ষেপ, ‘‘আমরা দিদির দলের পুরনো লোক। আর এই সে দিন দলে আসা ছেলেরা আমাদের উপরে জোর খাটালো? গ্রামের প্রতিবন্ধী ছেলের উপরে হাত উঠল?’’ এলাকার কিছু নেতার অন্য অপকর্ম নিয়েও সরব তাঁরা। তাঁদের অভিযোগ, নতুন তৈরি
সেতুর পাশেই একটি বাঁশের সেতু রয়েছে। তা দিয়ে চলা গাড়ি থেকে প্রতিদিন জোর করে টাকা তোলা হচ্ছে। সে সব কেউ দেখেও দেখছে না।
তৃণমূলের হুগলি জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্ত অবশ্য জোরাজুরি বা মারধরের অভিযোগ মানতে রাজি নন। তাঁর দাবি, ‘‘কাউকে জোর করার প্রশ্নই আসে না। যাঁরা জমি দিয়েছেন, স্বেচ্ছায় দিয়েছেন।’’ বাঁশের সেতুতে গাড়ি থেকে টাকা তোলার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘কারও বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে দলের তরফে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
অ্যাপ্রোচ রোডটির গুরুত্ব অবশ্য কেউই অস্বীকার করছেন না। স্থানীয় সামন্ত রোডের সঙ্গে আপ্রোচ রোডটি যুক্ত হলে তবেই সেতুটি চালু হবে। খানাকুলের পথে ২০ কিলোমিটার রাস্তা কমে যাবে। হাওড়া ও হুগলির অন্তত ৫০টি গ্রামের বেশ কয়েক হাজার মানুষ উপকৃত হবেন। তবে চাষিদের বক্তব্য, ‘‘আমরা উন্নয়নবিরোধী নই। আমরা বাধা দিলে সেতু বা রাস্তা হতো? কিন্তু আমাদেরই সরকার আমাদের দিকটা দেখল না।’’
এক চাষি বলেন, ‘‘আমাদের মোট ৩৯৯ জন চাষির জমি গিয়েছে। নদীর দু’পারে যাঁদের জমি আগেই জলে চলে গিয়েছে কেবল তেমনই কিছু মানুষ চেক নিয়েছেন। আমরা ২৮৬ জন চাষি সরকার নির্ধারিত দামে চেক নিইনি। আমরা জমির দাম একটু বেশি চেয়েছিলাম।’’ হুগলির জেলশাসক সঞ্জয় বনশল অবশ্য বলেন, ‘‘যে চাষিরা বেশি টাকা দাবি করছেন, আইনি রাস্তাতেই তাঁদের তা পাওয়ার সুযোগ এখনও আছে। তার জন্য বিধিবদ্ধ ভাবে তাঁরা আদালতে আবেদন করতে পারেন।’’
বেশি জমি অধিগ্রহণ করে কম করে দেখানোর অভিযোগও তুলেছেন অনেক চাষি। এক চাষির অভিযোগ, ‘‘দু’টি আলাদা জায়গা থেকে আমার জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। দু’জায়গার জমি মিলিয়ে ২৮ শতক। কিন্তু সরাকরি খাতায় দেখানো হয়েছে ৯ শতক। আরও কিছু চাষির জমির মাপে এই ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে।’’ জেলাশাসকের আশ্বাস, ‘‘জমির দাম নিয়ে আপত্তি ছাড়া চাষিদের যদি অন্য কোনও বক্তব্য থাকে, এখনও তাঁরা তা জানাতেই পারেন।’’