চোখের জলই একমাত্র প্রতিবাদ, বলছেন বোন

যমে-মানুষে টানাটানি চলছিল দেড় মাসেরও বেশি। এই ক’দিন চুঁচুড়ার লক্ষ্মীনারায়ণ মুখোপাধ্যায় বারেবারে চেয়েছেন, তাঁর আদরের বাবাই যেন অন্তত প্রাণে বাঁচে। কিন্তু সোমবারের সকাল হতাশায় ডুবিয়ে দিল পঁচাত্তরের বৃদ্ধকে। মৃত্যু হল রাজনৈতিক সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে বোমার আঘাতে গুরুতর জখম দুবরাজপুর থানার সাব-ইনস্পেক্টর অমিত চক্রবর্তীর। যাঁকে তিন বছর বয়স থেকে বাবাই নামেই ডাকতেন লক্ষ্মীনারায়ণবাবু। যিনি পিসেমশাই হয়েও পিতৃস্নেহে বড় করে তুলেছিলেন বাবাইকে। তাঁর মৃত্যু-সংবাদ শুনে আর নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননি। দোতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ওই বৃদ্ধ।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

চুঁচুড়া শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৪ ০৩:২৮
Share:

শোকাতুর লক্ষ্মীনারায়ণ মুখোপাধ্যায় ও শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়। সোমবার চুঁচুড়ার বাড়িতে। ছবি: তাপস ঘোষ

যমে-মানুষে টানাটানি চলছিল দেড় মাসেরও বেশি।

Advertisement

এই ক’দিন চুঁচুড়ার লক্ষ্মীনারায়ণ মুখোপাধ্যায় বারেবারে চেয়েছেন, তাঁর আদরের বাবাই যেন অন্তত প্রাণে বাঁচে। কিন্তু সোমবারের সকাল হতাশায় ডুবিয়ে দিল পঁচাত্তরের বৃদ্ধকে।

মৃত্যু হল রাজনৈতিক সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে বোমার আঘাতে গুরুতর জখম দুবরাজপুর থানার সাব-ইনস্পেক্টর অমিত চক্রবর্তীর। যাঁকে তিন বছর বয়স থেকে বাবাই নামেই ডাকতেন লক্ষ্মীনারায়ণবাবু। যিনি পিসেমশাই হয়েও পিতৃস্নেহে বড় করে তুলেছিলেন বাবাইকে। তাঁর মৃত্যু-সংবাদ শুনে আর নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননি। দোতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ওই বৃদ্ধ।

Advertisement

শুধু কি তাই?

অমিতের মৃত্যু-সংবাদ একরাশ অন্ধকার ঢেলে দিয়েছে তাঁর অতি প্রিয় ‘কুটু’ ওরফে লক্ষ্মীনারায়ণবাবুর মেয়ে শর্মিষ্ঠার জীবনেও। বাবাকে সামলানোর ফাঁকেই এ দিন তিনি বলেন, “এই ঘটনায় প্রতিবাদের কোনও ভাষা আমাদের জানা নেই। চোখের জলই একমাত্র প্রতিবাদ। আমরা কোনও সমস্যায় পড়লে দাদা সমাধান করত। এখন আর আমাদের পাশে কেউ রইল না।”

চুঁচুড়ার রথতলার বাসিন্দা, পুলিশকর্মী প্রদীপ চক্রবর্তীর ছেলে ছিলেন অমিত। তিন বছর বয়সে অমিতের বাবা-মা মারা যান। সেই থেকে অমিত ও তাঁর বোন অমিতা ওই এলাকারই বাসিন্দা, পিসেমশাই লক্ষ্মীনারায়ণবাবু এবং পিসিমা শেফালিদেবীর কাছে মানুষ। লক্ষ্মীনারায়ণবাবু সাহাগঞ্জের ডানলপ কারখানার কমী ছিলেন। ১৯৯৮ সালে ওই কারখানা বন্ধ হওয়ার পরে তাঁর সংসারে অচলাবস্থা দেখা দেয়। বকেয়া না পাওয়ায় পরে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন লক্ষ্মীনারায়ণবাবু।

পিএসসি পরীক্ষা দিয়ে ১৯৯৯ সালে কনস্টেবল হিসেবে বর্ধমান থানায় যোগ দিয়ে পিসেমশাইয়ের সংসারের হাল ধরেন অমিত। তার পরে একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে ২০০৮ সালে সাব-ইনস্পেক্টর হন। প্রথমে নানুর থানায় যোগ দেন ওই পদে। তার পরে আমোদপুর, তারাপীঠ হয়ে দুবরাজপুর থানায় কাজ শুরু করেন গত বছর অগস্টে। মাস ছয়েক আগে অমিতার বিয়েও দিয়েছেন। পিসতুতো বোন শর্মিষ্ঠা লাইব্রেরি-বিজ্ঞান নিয়ে এমএ পড়ছেন হুগলির মহসিন কলেজে। সেই বোনের পড়াশোনারও যাবতীয় খরচ চালাতেন অমিত। এক কথায়, গোটা পরিবারকে মাথায় তুলে রেখেছিলেন।

গত ১ জুন চুঁচুড়ায় আসেন অমিত। ফিরে যান ৩ জুন। ওই দিন বিকেলেই দুবরাজপুরে রাজনৈতিক সংঘর্ষ সামলাতে গিয়ে বোমার আঘাতে গুরুতর জখম হন। চিকিৎসা চলছিল দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তখন থেকেই হাসপাতালের পাশে একটি গেস্ট হাউসে থাকছিলেন শেফালিদেবী। প্রতিদিন সকালে হাসপাতালে যেতেন। ফিরে আসতেন সেই রাতে। সোমবার অমিতের মৃত্যুর পরে হাসপাতালে অন্য আত্মীয়দের সঙ্গে অমিতাকে দেখা গেলেও শেফালিদেবীকে দেখতে পাওয়া যায়নি। অমিতা শোকে ভাবলেশহীন হয়ে পড়েন। দুপুর ১টা নাগাদ দেহ হাসপাতাল চত্বরে নামিয়ে আনার পরে অমিতাই মুখে জল দেন। দেহ নিয়ে যাওয়া হয় দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালের মর্গে। ময়না-তদন্ত শেষ হওয়ার পরে বিকেলে দেহ নিয়ে বীরভূম রওনা দেয় সেখানকার পুলিশ।

চোখে গ্লুকোমা থাকায় ভাল মতো দেখতে পান না লক্ষ্মীনারায়ণবাবু। দিনভর আপন মনেই আউড়ে যেতে থাকেন বাবাইয়ের নানা কথা। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ফাঁকে শর্মিষ্ঠার চোখ বেয়েও জল নামে। বলতে থাকেন, “বাবার চিকিৎসায় বিস্তর খরচ। আমরা পথে বসে গেলাম। দাদা প্রাণে বেঁচে থাকলেও আমরা ভাইবোনে টিউশন পড়িয়ে চালিয়ে দিতাম। রাজনীতির লড়াই দাদাকে কেড়ে নিল।”

সহ প্রতিবেদন: সুব্রত সীট ও তাপস ঘোষ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement