বনগাঁয় মৃত স্বপন কুণ্ডুর স্ত্রী
রাশি রাশি টাকা খরচ করলাম। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে স্বামীকে কলকাতার রাজাবাজারের নার্সিংহোমে ভর্তি করলাম। কিন্তু বাঁচাতে পারলাম না, এই আফসোস তো সারা জীবন থাকবেই। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়েছে ওই নার্সিংহোমের ডাক্তারবাবুর দেওয়া ‘ডেথ সার্টিফিকেট’!
মঙ্গলবার স্বামী স্বপনকুমার কুণ্ডু মারা গেলেন ডেঙ্গিতে। বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে আগে ওঁর রক্ত পরীক্ষা করিয়ে ‘এনএস-১ পজিটিভ’ মিলেছিল। ওখানকার ডাক্তারবাবুরা বলেছিলেন, ওঁর প্লেটলেটও অনেক নেমে গিয়েছিল। কিন্তু রাজাবাজারের নার্সিংহোমের ডাক্তারবাবু ‘ডেথ সার্টিফিকেটে’ মৃত্যুর কারণ হিসেবে লিখলেন, ‘সাডেন কার্ডিও রেসপিরেটরি ফেলিওর’! আমার দেওর কানাই কত করে ওই ডাক্তারবাবুকে বললেন, দাদার তো ডেঙ্গি হয়েছিল। সে কথা লিখলেন না? ডাক্তারবাবু কিছুতেই রাজি হলেন না। এমনটাও হয়?
স্বপন এবং বড় মেয়ে মিঠু— দু’জনেরই জ্বর হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার ওঁদের বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করি। দু’জনেরই রক্ত পরীক্ষায় ‘এনএস-১ পজিটিভ’ মেলে। সুস্থ হয়ে মঙ্গলবার মেয়ে বাড়ি ফেরে। কিন্তু স্বামীকে ফেরাতে পারলাম না। সোমবার সন্ধ্যায় ওই হাসপাতালের ডাক্তারবাবু হঠাৎ জানান, ওঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। দ্রুত কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে আইসিসিইউতে রেখে চিকিৎসা করাতে হবে। তড়িঘড়ি আধুনিক ভেন্টিলেটর থাকা অ্যাম্বুল্যান্সের খোঁজ করলাম। পেলাম না। শেষে এক চিকিৎসকের সাহায্যে কলকাতার মুকুন্দপুর থেকে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে আসা হয়। স্বামীকে কলকাতার এনআরএস হাসাপাতালে নিয়ে যাব বলে ঠিক করি। অ্যাম্বুল্যান্স ১২ হাজার টাকা ভাড়া চায়। মুকুন্দপুর থেকে অ্যাম্বুল্যান্স আসতে সময় লেগেছিল প্রায় তিন ঘণ্টা। রাত
১২টা নাগাদ রওনা হয়ে আড়াইটে নাগাদ এনআরএসে পৌঁছই। কিন্তু জায়গা মেলেনি। ওখানকার আইসিসিইউ-তে নাকি কোনও বেড ফাঁকা ছিল না!
কী করি? ওঁকে নিয়ে রওনা দিলাম বেলেঘাটা এলাকার দু’টি নার্সিংহোমে। অ্যাম্বুল্যান্স চালকও সুযোগ বুঝে আরও এক হাজার টাকা ভাড়া হাঁকলেন। কিন্তু ওই এলাকার দু’টি নার্সিংহোমও ভর্তি নিল না। ওখানেও নাকি আইসিসিইউ-তে কোনও শয্যা ফাঁকা নেই। অ্যাম্বুল্যান্স-চালককে আরও চার হাজার টাকা দিয়ে রাজাবাজারের ওই নার্সিংহোমে যখন পৌঁছলাম, তখন ভোর সাড়ে ৪টে। ভেন্টিলেটরে স্বামীর জায়গা হল। কিন্তু সাড়ে ৯টা নাগাদ জানানো হল, ও আর বেঁচে নেই।
মৃতদেহ নিয়ে ফিরে এলাম বনগাঁর ট-বাজারে আমাদের বাড়িতে। ভারী অদ্ভূত লাগছে! একজন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে কেন এত ঘুরতে হবে, বুঝতে পারছি না। এত ঘোরাঘুরিতেই তো অনেক সময় নষ্ট হল। না হলে হয়তো স্বামীকে বাঁচাতে পারতাম। আমাদের মতো গরিব মানুষের জন্য কলকাতার সরকারি হাসপাতালে কি কোনও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই?
ওঁর চালের ব্যবসা ছিল। ওঁর আয়েই সংসার চলত। এখন কী হবে জানি না।