হিকমপুর উচ্চ বিদ্যালয়। নিজস্ব চিত্র
হিকমপুরের নাম শুনলে গোটা তল্লাটই এক সময় চমকে উঠত। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের গা লাগোয়া এই গ্রামে যে কথায় কথায় বোমা-গুলি বেরোত। কিন্তু এখন এই গ্রামের নাম মানুষ জানেন হিকমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্য। যে স্কুল এ বছর রাজ্যের সেরা বিদ্যালয় (উচ্চ মাধ্যমিক) হিসেবে যামিনী রায় পুরস্কার পেয়েছে। ৩ জানুয়ারি কলকাতায় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এই বিদ্যালয়কে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরস্কার দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে সেই কর্মসূচি স্থগিত হয়ে গিয়েছে। গ্রামের বাসিন্দা তথা পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলের মিজারুল শেখ বলেন, ‘‘এক সময়ে বোমা, গুলির আওয়াজে উত্তপ্ত হয়ে থাকত হিকমপুর। মানুষের দিন কাটত আতঙ্কে। কিন্তু এই বিদ্যালয় তার পরিবর্তন ঘটিয়েছে।’’
স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাই নানা পরিবারের কাছে গিয়ে তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য নিয়মিত লড়াই করে গিয়েছে। তাতে ফলও হয়েছে। সাক্ষরতার হার বেড়েছে। অনেক ছাত্রছাত্রী তাদের বাবা-মা-কে পড়াশোনা শিখিয়েছে। স্কুলের গ্রন্থাগার থেকে পড়ুয়ারাই নানা ধরনের বই নিয়ে আসে বাড়ির বড়দের জন্য। স্কুলে ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন থেকে শুরু করে ব্যবহৃত ন্যাপকিন ডিসপোজ়াল মেশিনের ব্যবস্থা রয়েছে। মিনি ইন্ডোর গেমস কমপ্লেক্সে ভলিবল ও ব্যাডমিন্টনের কোর্ট রয়েছে। করোনার বিধি নিষেধের আগে প্রেক্ষাগৃহ, খোলা মঞ্চে নিয়মিত অনুষ্ঠান হত। গ্রামের মানুষের সামনে তা খুলে দিত বিশ্ব সংস্কৃতির জানলা। সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও তা কাজে লাগাতেও সফল শিক্ষক ও পড়ুয়ারা। একটি বিজ্ঞান সংগ্রহশালার কাজ চলছে। গোটা বিদ্যালয়টি যেন সংগ্রহশালা। স্কুলে কৃষিকাজ নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবিরও বসেছে বেশ কয়েক বার। শোলা, মাটির কাজের কর্মশালাও নিয়মিত হয়। তাতে গ্রামের মানুষের সঙ্গে স্কুলের সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়েছে।
বহরমপুরের আইসি জানান, আর তাতেই এক সময় যে গ্রামের নাম শুনলে দুঁদে পুলিশ অফিসারেরও ভুরু কুঁচকে উঠত, সেই গ্রাম থেকে গত বেশ কয়েক বছরে বোমা-গুলির অভিযোগ ওঠেনি।
কৃষিকাজ আর দিনমজুরিই মোটামুটি ভাবে এখানে সাধারণ মানুষের পেশা। ষাটের দশকের শেয দিক থেকে একটি জুনিয়ার হাই স্কুল ছিল, কিন্তু পড়াশোনার চল তেমন ছিল না। ২০০৯ সালে স্কুলটি মাধ্যমিক পর্যন্ত করা হয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত হয় ২০১৩ সালে। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ২০০৭ সালে। তখন থেকেই গ্রামে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। গ্রামের শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষক আবু তাহের বলেন, ‘‘আগে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়তে গেলে দূরের স্কুলে যেতে হত। অনেকেই সন্তানদের ছাড়তেন না। এখন গ্রামেই সেই সুযোগ পেয়ে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহও বেড়েছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘গ্রামের বাসিন্দাদের শান্তিপূর্ণ সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে এনেছে তাঁদের সন্তানেরাই। পড়াশোনা করে ভাল চাকরি পাওয়ার আশা জেগেছে গ্রামের নতুন প্রজন্মের। তাতেই বদলে গিয়েছে হিকমপুর।’’
লকডাউনের সময় সঞ্জয়বাবুর নেতৃত্বে স্কুল থেকে ৮ হাজার মাস্ক বিলি হয়েছে। শিক্ষকদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে গ্রামের গরিব মানুষদের খাবার দেওয়া হয়েছে। ওই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী বেবী নাজমিন শিশু সংসদের প্রধানমন্ত্রী। বেবি বলছে, ‘‘একটি বিদ্যালয় যে একটি গ্রামকে পরিবর্তন করতে পারে তার উদাহরণ হল আমাদের বিদ্যালয়।’’ মিজারুল জানান, এই পরিবর্তনের জন্য বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কেই কৃতিত্ব দিতে হবে। সঞ্জয়বাবু বলেন, ‘‘গ্রামের মানুষও চাইছিলেন ওই আতঙ্কের আবহ থেকে বেরিয়ে আসতে। আমরা কেবল তাঁদের সেই পথটা দেখিয়ে দিয়েছি।’’ মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার কে শবরী রাজকুমার বলেন, ‘‘হিকমপুর এখন শান্ত।’’ বহরমপুরের বিডিও অভিনন্দন ঘোষ বলেন, ‘‘একটি স্কুলের হাত ধরে যে একটি গ্রাম ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তা খুবই আনন্দের। স্কুলটি নজির হয়ে থাকবে।’’