প্রতীকী ছবি।
ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল ‘খবর’টি। উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব চড় মেরেছেন তাঁর বাবা মুলায়ম সিংহ যাদবকে! কোনও রাজ্যের ‘মুখ’ এমন পারিবারিক হিংসার উদাহরণ তৈরি করায় তা নিয়ে রীতিমতো শোরগোল পড়েছিল। যাদব পরিবারের বিচার করতে পথে নেমেছিলেন অনেকেই। পরে জানা যায়, যখন ওই ঘটনা ঘটেছে বলে ‘খবর’, তখন বাবা-ছেলে একে অপরের থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে ছিলেন!
একই রকম ‘খবর’ হয়েছিল বসিরহাটের হিংসার একটি ভিডিয়ো থেকে, যা দেখে দেশ আঁতকে উঠেছিল। পরে জানা যায়, একটি ভোজপুরি সিনেমার দৃশ্য ‘এডিট’ করে ওই ভিডিয়ো তৈরি করে বসিরহাট হিংসার ‘খবর’ তৈরি করা হয়েছিল!
কী ভাবে হয় এ সব খবর?
২০১৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দলীয় সভাপতি থাকাকালীন রাজস্থানে বিজেপি-র এক সভায় দেশের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, “আমরা যে কোনও বিষয়কে ভাইরাল করতে পারি। সত্যি-মিথ্যে, টক বা মিষ্টি।” এর পরে এক বিজেপি কর্মীকে অখিলেশের চড় মারার বার্তা ছড়িয়ে ‘খবর’ করার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “জানি তোমরা এ সব ভাল করতে পার। কিন্তু এ সব কোরো না। করা ঠিক নয়।” বসিরহাটের তৃণমল সাংসদ নুসরত জহান দিন কয়েক আগে সরাসরিই বলেছেন, “বিজেপি-ই দেশের ভুয়ো খবরের ভেন্ডিং মেশিন।”
যদিও ভোটমুখী বঙ্গে মনে হচ্ছে কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল নয়, প্রায় সব পক্ষই ছড়িয়ে চলেছে ভুয়ো খবর। অভিযোগ, সেই কাজই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আইটি শাখাগুলি সংগঠিত ভাবে করে থাকে। আরও অভিযোগ, এতে পুলিশ-প্রশাসন কারওরই নজর থাকে না। যদিও দুর্গাপুজোয় কার্ফু জারি, অতিমারি বা লকডাউনের ভুয়ো খবরের বিরুদ্ধে পুলিশ কড়া অবস্থান নিয়েছিল।
চিন্তা আরও বাড়িয়ে ‘ইন্টারনেটের বিপদ’ সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্ট বলছে, নজরদারি, ভুয়ো খবর আর গুজব ছড়ানোয় বর্তমানে শীর্ষে ভারত। ছেলেধরা, কিডনি পাচার বা চোর সন্দেহে ছড়ানো ভুয়ো খবর বা গুজবকে কেন্দ্র করে হিংসায় গত এক বছরে প্রাণ গিয়েছে অন্তত ৮৫ জনের। রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে ৫৭ শতাংশ মানুষ ভুয়ো খবরের শিকার। সেখানে ৬৪ শতাংশ ভারতবাসী ভুয়ো খবরের দ্বারাই মতামত স্থির করেন। বিশ্বে গুজবের শিকার ৫০ শতাংশ মানুষ, ভারতে ৫৪ শতাংশেরও বেশি। সাইবার গবেষকেরা বলছেন, “ভোটের আগে জনমতকে প্রভাবিত করতে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই অস্ত্রই যে বেশি ব্যবহৃত হবে তাতে আশ্চর্য কী?”
এ রাজ্যে একটি রাজনৈতিক দলের আইটি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বললেন, “শুরুর দিকে কাজ ছিল নানা হিংসার ও গন্ডগোলের ভিডিয়ো ফুটেজ বা ছবি সংগ্রহে রাখা। সিনেমা বা সিরিয়ালের ফুটেজ হলেও চলবে। তার সঙ্গেই দলের গ্রাফিক ডিজ়াইনার বা এডিটরদের বলা হয়েছিল, ভাল ভাল বক্তব্যের সঙ্গে একাধিক হেডলাইন তৈরি রাখতে, যাতে যে কোনও সময়ে যে কোনও একটা হেডলাইনের সঙ্গে ফুটেজ জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া যায়।” ওই আইটি শাখারই আর এক সদস্যের দাবি, “জেলায় প্রচারে যাওয়া ভোটপ্রার্থীর আঘাত লাগার ঘটনার পরে এ ভাবেই ফুটেজ ছড়িয়ে বোঝানো হয়েছে, আঘাত আসলে লাগেইনি।” ওই কর্মী জানাচ্ছেন, ফেসবুকে ধরা পড়ার ভয় থেকে এই ধরনের ভুয়ো প্রচার সাধারণত এড়িয়ে চলা হয়। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এমন প্রচার ছড়ায় দাবানলের মতো। তাই গ্রুপে সদস্য সংখ্যা বা খবর ফরোয়ার্ড করার সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকলেও সমস্যা হয় না।
আর একটি রাজনৈতিক দলের আইটি শাখার কর্মীর মন্তব্য, “প্রতি বিধানসভা কেন্দ্র ধরে ধরে ফেসবুক পেজের চেয়ে তাই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলার দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়। কাগজে কিছু লিখে ভুয়ো স্ট্যাম্প মেরে ছড়িয়ে দিলেই বিশ্বাস করেন অনেকে। আর তরুণ প্রজন্মের তো ইতিহাস সম্পর্কে তেমন ধারণাই নেই। ফলে ভিডিয়ো আর ছবি একটু বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারলেই হল।”
‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব অ্যান্টি হ্যাকিং’-এর অধিকর্তা তথা সাইবার গবেষক সন্দীপ সেনগুপ্ত বললেন, “টুইটার, ফেসবুক, গুগল ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও প্রচারের উৎস ধরতে পারা সহজ নয়। ঠিক-ভুলের হিসেব এমন ভাবে গুলিয়ে দেওয়া হয় যে, মত স্থির রাখাই শক্ত। যতক্ষণে উৎস ধরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ততক্ষণে ভোটই শেষ, জনমত পকেটে!”
তা হলে উপায়? সাইবার গবেষকদের পরামর্শ, সমাজমাধ্যমের ব্যবহারকারীদেরই সচেতন হতে হবে। নিশ্চিত না-হওয়া পর্যন্ত ভাবতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখা বা শোনা যাচ্ছে, তা বাস্তব না-ও হতে পারে।