মুম্বইয়ের মুন্নাভাইকেও লজ্জা দেবে এ রাজ্যের সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির প্রতারণা চক্র।
সিধে উপায়ে এমবিবিএস পাঠ্যক্রমে ভর্তি হওয়া যাবে না বুঝে বলিউডের ছবির ‘ডন’ মুন্নাভাই ভুয়ো পরীক্ষার্থী বসিয়ে পাশ করেছিল মেডিক্যালে ভর্তির পরীক্ষা। কলকাতার প্রতারকরা পদ্ধতিটা ঠিক উল্টে দিয়েছে। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে-চাওয়া প্রার্থীই কেবল খাঁটি। মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার তরফে পাঠানো ‘সিলেকশন’ চিঠি, ইন্টারভিউ-নেওয়া ‘অধ্যক্ষ’, কলেজের প্যাডে ছাপা ভর্তির চিঠি, পডুয়ার নাম-সহ কলেজের ওয়েবসাইট, সব ভুয়ো। তা ফাঁস হওয়ার আগেই প্রার্থীদের থেকে কয়েক লক্ষ টাকা ‘ডেভেলপমেন্ট ফি’ নিয়ে উধাও হয়েছে প্রতারকেরা।
পুরুলিয়ার এক প্রতারিত ছাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের দুই চতুর্থ শ্রেণির কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের জেরা করে ক্রমশ ভুয়ো ভর্তি চক্রের যে ছবি স্পষ্ট হচ্ছে, তাতে তাজ্জব পুলিশও। চক্রের মূল পাণ্ডা সঞ্জয় সিংহ, অবিনাশ যাদব এবং সুধাংশু মিশ্রকে খুঁজছে পুলিশ। অবিনাশ ও সুধাংশু টালিগঞ্জের চন্ডী ঘোষ রোডে একটি বাড়ির একতলা ভাড়া নিয়ে ‘ব্রেনস্টর্ম’ নামে একটি সংস্থা খুলে বসেছিল এপ্রিল থেকে। এখন সেই সংস্থা তালাবন্ধ। বাড়ি ভাড়া বকেয়া রেখে উধাও হয়েছে তারা। বাড়ির মালিক পীযূষ মুখোপাধ্যায় থানায় অভিযোগও করেছেন।
চারজন প্রতারিত প্রার্থীর খোঁজ ইতিমধ্যেই মিলেছে। পুলিশের সন্দেহ, আরও অনেককে ঠকিয়েছে ওই চক্র। উদ্বেগ বেড়েছে মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক ও কর্মচারীদের একাংশের ওই চক্রে জড়িত থাকার সম্ভাবনায়। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সমীর ঘোষ রায় বলেন, ‘‘অধ্যক্ষের ‘প্যাড’ জাল করা হয়েছে। এমসিআই-এর ‘প্যাড’ জাল করে ভর্তির চিঠি দেওয়া হচ্ছে। কলেজে বসেই ভুয়ো ইন্ডারভিউ, মেডিক্যাল পরীক্ষা করানো হচ্ছে। ভিতরের কেউ যুক্ত না থাকলে এটা সম্ভব নয়। ’’
রাজ্যে এমন ঘটনার নজির নেই, বলছেন স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি শুক্রবার বলেন ‘‘ভর্তির বিষয়ে নানা ধরনের প্রতারণার কথা কানে এসেছে। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের ভিতরে প্রতারণার কথা আগে শুনিনি।’’ কলকাতা থেকে দূরে বলেই হয়তো উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে এমন চক্র চালানো সম্ভব হয়েছে, বলেন তিনি।
কী ভাবে চলছিল ওই প্রতারণা চক্র? নানা পক্ষের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানাচ্ছে, জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসা প্রার্থীদের ঠিকানা, ফোন নম্বর জোগাড় করত প্রতারকেরা। ফল বেরোনোর পর মেধা তালিকার তলার দিকে থাকা প্রার্থীদের টেলিফোন করে টোপ দেওয়া হত ‘ম্যানেজমেন্ট কোটা’-তে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার। টালিগঞ্জের অফিসে প্রার্থীদের ডেকে পাঠিয়ে বলা হত, ভর্তির ‘অফার লেটার’ পেলে তবেই টাকা নেওয়া হবে। চেক-এর মাধ্যমে, কিংবা সরাসরি অ্যাকাউন্টে টাকা নিতেও রাজি ছিল প্রতারকেরা।
এর পর প্রার্থীদের কাছে মেডিক্যাল কাউন্সিলের প্যাডে ছাপা চিঠি আসত। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে ‘সেন্ট্রাল নমিনি’ হিসেবে প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার খবর দিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার নির্দেশ এসেছে একাধিক প্রার্থীর কাছে। এর ভিত্তিতে প্রার্থী সেখানে গেলে কলেজে ‘অধ্যক্ষের ঘর’ হিসেবে সাজানো ঘরে তার ‘কাউন্সেলিং’ হত, ভর্তির চিঠি মিলত, ওয়েবসাইটে তার নামও দেখিয়ে দেওয়া হত। তার পরেই ‘ডেভেলপমেন্ট ফি’ হিসেবে টাকা দিতে হত প্রার্থীকে।
পুরুলিয়ার প্রতারিত ছাত্রীর বাবা সরকারি কর্মী। তিনি চেক, নগদ এবং সরাসরি টাকা ট্রান্সফার করে প্রায় ১৬ লক্ষ টাকা দিয়েছেন। এর মধ্যে কলেজের ‘অধ্যক্ষের’ হাতে ডেভেলপমেন্ট ফি হিসেবে ৮ লক্ষ এবং ৭ লক্ষ টাকার দুটি চেক দেন তিনি। যদিও ‘অধ্যক্ষের’ অনুরোধে চেক-এ প্রাপকের নাম লেখেননি। এ ছাড়া ভর্তির চিঠি হাতে পেয়ে ‘ব্রেনস্টর্ম’ সংস্থার অ্যাকাউন্টে ১ লক্ষ টাকা ট্রান্সফার করে দেন তিনি।
পুলিশ জানতে পেরেছে, দুটি পৃথক ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে জমা করে ওই চেক দুটি ভাঙিয়ে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। ‘ব্রেনস্টর্ম’ সংস্থার অ্যাকাউন্ট রয়েছে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে। ছাত্রীর বাবা জানিয়েছেন, একটি বাড়ি বিক্রি করে তিনি মেয়েকে ভর্তির টাকা জোগাড় করেছিলেন।
প্রতারিতদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পেরেছে, কখনও প্রসূতিবিভাগের বহির্বিভাগের একটি ঘর, কখনও ডেন্টাল কলেজের নিরাপত্তারক্ষীর ঘর কলেজ অধ্যক্ষের ঘরের মতো করে সাজিয়ে ‘ইন্টারভিউ’ নেওয়া হত প্রার্থীদের। ধৃত দুই চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, শ্যামসুন্দর মল্লিক এবং সঞ্জয় মল্লিক জেরায় পুলিশকে জানিয়েছে, কোনও ভাবে মেডিক্যাল কলেজের ঘর বা আউটডোরে বসার ব্যবস্থা করে দিতে পারলে একদিনে প্রায় ২০ হাজার টাকা করে পেয়েছে তারা। পুলিশ এক চিকিৎসকেরও খোঁজ পেয়েছে, যাঁকে ওই ভুয়ো সংস্থার তরফে ৫ লক্ষ টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল শুধুমাত্র সাদা অ্যাপ্রন পরে কাগজপত্র পরীক্ষার অভিনয় করার জন্য। সম্ভবত তিনি হাউজস্টাফ। প্রার্থীদের বিশ্বাস তৈরি করতে আউটডোরে সাদা অ্যাপ্রন-পরা এক ‘ডাক্তার’-এর সঙ্গেও তাদের কথা বলিয়ে দেওয়া হত বলে জানা যাচ্ছে। মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে যুক্ত এই ব্যক্তিরা কারা, খোঁজ করছে পুলিশ। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা বলেন, ‘‘চক্রের অন্যদের ধরতে পুলিশ তদন্ত করছে।’’