bankura

দেশ-পুজোর পঁচাত্তরেও সুদূরে সুদিন

শিবু কিস্কু বয়সেও দেশের স্বাধীনতার থেকে কয়েক মাসের বড়। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট ভারতের স্বাধীনতা যখন সদ্যোজাত, শিবু তখন মাস পাঁচেক।

Advertisement

দেবাঞ্জনা ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:৫১
Share:

ভাঙা ঘরের সামনে শিবু কিস্কু। ছবি: অভিজিৎ অধিকারী।

পরনের আধময়লা লুঙ্গিটা সে দিন আর দু’ফেত্তা করে কোমর অবধি তোলেননি। পায়ে লোটাচ্ছিল নীল চেক। রংচটা শার্টটাও হাত দিয়ে ঘষেই ওই একটু ইস্ত্রি মতো করে নিয়েছিলেন। হাজার হোক ‘পুজো’য় ডাক এসেছে। যে সে ‘পুজো’ নয়— সবচেয়ে ‘বড় পুজো’।

Advertisement

শিবু কিস্কু বয়সেও দেশের স্বাধীনতার থেকে কয়েক মাসের বড়। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট ভারতের স্বাধীনতা যখন সদ্যোজাত, শিবু তখন মাস পাঁচেক। জ্ঞান হওয়া ইস্তক শুনেছেন, ‘‘তোর তো স্বাধীনতার বচ্ছরে জন্ম।’’ বাবা গোরাচাঁদও বলতেন, ‘‘আমার ঘরে ছেলে এল, দেশও বেড়ি খুলে নিজের পায়ে দাঁড়াল। এক নয় চার সাত— সনটা নিজেই তো ইতিহাস রে।’’

সেই ইতিহাসের এ বার পঁচাত্তর। শিবুও ৭৫। ‘অমৃত মহোৎসবে’ বচ্ছরভর দেশ-পুজো। তাঁদের গ্রামও ছুঁল আজ়াদির রোশনাই। ১৫ অগস্ট সক্কাল সক্কাল সুতোয় টান দিলেন শিবু। পতপতিয়ে উড়ল তেরঙ্গা। কানগড়ের মাটিতে এই প্রথম। কুচো ফুলে রঙিন হল বেদি। বাতাসে সুরের সুবাস— ‘তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে’।

Advertisement

সার্থক নাম বটে এই আদিবাসী গ্রামের। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর মহকুমা সদর থেকে কমবেশি ১০ কিলোমিটার দূরে বেলশুলিয়া পঞ্চায়েতের গ্রামটি উন্নয়নে কানা-ই রয়ে গেল। গা ঘেঁষা জঙ্গল ফুঁড়েছে রেললাইন। পাশে বিশ্বযুদ্ধের আমলের পরিত্যক্ত এয়ারস্ট্রিপ। ট্রেনের ঝিক ঝিক আওয়াজ কানে আসে। বৃদ্ধ শিবু বলেন, ‘‘কাছেই রেললাইন। একসময়ে হাওয়াই জাহাজও নামত। কিন্তু এত দিনেও পায়ে চলার পথটুকু ভাল হল না। এবড়ো-খেবড়ো সরু মাটির রাস্তা ভেঙে তিন-চার কিলোমিটার এগোলে মোরাম মেলে। ঘরদোর সব ভাঙা। জলের কষ্টটাও তো মিটল না।’’ গাঁয়ের ২৩টা মাটির ঘরেই এক হুতাশ।

ভাঙা ঘরে ভাঙা তক্তপোশ, খিদে-তেষ্টা গিলে বাঁচার লড়াই, লেখাপড়ার দোরে খিল— এ সব যেন শিবুদের উত্তরাধিকার। ঠাকুরদা বাবুলাল কিস্কু ইংরেজ সাহেবের চাবুক সয়ে নীল বুনেছেন। বাবা গোরাচাঁদ ছিলেন ভাগচাষি। পরের জমিতে মুনিশ খেটে ন’টা ছেলেমেয়ের সংসারটা টানতেন। আর মা রানি ছোট্ট শিবুকে বুকে আগলে বলতেন, ‘‘রাজরাজড়ার দিন গ্যাছে গে। ইংরেজরাও দেশ ছাড়ল। এ বার দেখবি সুদিন আসবে।’’

‘‘দিন বদলের স্বপন দেখতাম আমিও। খুব লেখাপড়ার শখ ছিল। প্রথম যে দিন স্কুলে গেলাম, দু’-দু’টো খাল পেরিয়ে, কী আনন্দ! স্কুল থেকে জামাকাপড়ও দেবে বলল। তবে ওই প্রথম, আর ওই শেষ,’’— এত বচ্ছর পরেও বৃদ্ধের গলায় দলা পাকানো কান্না। স্কুল সেরে বাড়ি ফিরে শুনতে হয়েছিল, ‘‘কাল থেকে বাগাল খাটতি যাবি।’’ আর স্কুলমুখো হননি শিবু। পরের জমি চষেই জীবনের অর্ধেকটা কাটিয়েছেন। তবে তিনি যখন চল্লিশ ছুঁইছুই, তখন কৃষি দফতরে শ্রমিকের সরকারি চাকরি জোটে। এখন সেই পেনশনেই সংসার চলে।

সংসার বলতে ছেলে মঙ্গল আর স্ত্রী মালতী। ছেলে মৃগীরোগী। পড়াশোনা এগোয়নি, বিয়ে-থাও দেননি। ছয় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তবে কাছাকাছি স্কুল না থাকায় মেয়েদের পড়াতে পারেননি। কানগড়ে এখনও প্রাথমিক স্কুল বা অঙ্গনওয়াড়ি নেই। অনেক তদ্বির করে তিন কিলোমিটার দূরে পানশিউলিতে প্রাথমিক স্কুল হয়েছে। তার প্রথম সেক্রেটারি শিবুই ছিলেন। বৃদ্ধ বলেন, ‘‘লেখাপড়া ছাড়া কেউ এগোয় নাকি! অনেক সময় মা দুগ্গাকেও বলেছি— আমার তো হল না, ছেলেমেয়েগুলোকে ভালভাবে বাঁচার সুযোগ করে দিয়ো।’’

আদিবাসী গ্রামে পুজোর চল নেই। তবে সেই কিশোরবেলা থেকে বন্ধুদের সঙ্গে দুগ্গা-দর্শন করেন শিবু। বয়সকালে বিসর্জনের দিন সাঁওতালি প্রথায় দাঁশায় নাচ নেচেছেন। বার কয়েক অঞ্জলিও দিয়েছেন।

এ বার ১৫ অগস্ট তেরঙ্গার সুতোয় যখন টান দিলেন, সেই পুজো পুজো গন্ধটাই নাকে লেগেছিল। স্বাধীনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বেড়ে ওঠা পঁচাত্তুরে বৃদ্ধের মনে হয়েছিল, ‘‘এ তো পুজোই করলাম। মায়ের পুজো, দেশের পুজো।’’

কী চাইলেন এই মায়ের কাছে?

‘‘আমরা গরিব-গুর্বো মানুষ। দু’মুঠো খেতে পেলেই খুশি। আর একটু লেখাপড়া, একটু উন্নয়ন।’’— তালিকা নেহাতই ছোট। তবে ছোটর সে দাবিই গুমরে মরে। সরকার দুয়ারে পৌঁছয়, ভিন্‌দেশি চিতার বন্ধন-মুক্তি ঘটে দেশের মাটিতে। তবু শিবুদের স্বপন-পাখি ডানা মেলতে পারে না। পিঞ্জরেই বাঁধা পড়ে থাকে পঁচাত্তরের আকাঙ্ক্ষা— সুদিন কাছে এসো...

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement