মৃত্যুকে আটকাতে পারে, এমন কারও বা কিছুর দেখা এখনও মেলেনি। কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যু প্রায়শই আটকে যাচ্ছে আইনের আট-আশি-আটশো ফাঁসে।
ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে গড়িয়ার এক নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন বছর পঞ্চাশের অমল গঙ্গোপাধ্যায়। সংক্রমণের জেরে একের পর এক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যেতে থাকে। শেষে ‘লাইফ সাপোর্ট’ ব্যবস্থায় রাখা হয় তাঁকে। পরিবারের লোকজন এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বুঝতে পারছিলেন, বেঁচে ফেরার আশা নেই তাঁর। তরতরিয়ে বাড়তে থাকা নার্সিংহোমের বিল মেটাতেও নাভিশ্বাস উঠছিল পরিবারের। এই পরিস্থিতিতে ঠিক কী করা উচিত, তা বুঝে উঠতে না-পেরে সকলেরই দিশাহারা অবস্থা! বয়সটা ছেদ টেনে দেওয়ার মতো নয় বলেই অসহায়তা বাড়ছিল পরিবারের।
শুধু অমলবাবুর পরিবার নয়, বহু পরিবারের কাছেই এই সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বেশ বড় সমস্যা। প্রশ্ন উঠছে, লাইফ সাপোর্ট (জীবন-যষ্টি বা কৃত্রিম উপায়ে জীবনবৃত্ত সচল রাখা) খুলে নিয়ে মৃত্যু ত্বরান্বিত করাটাই কি সমাধানের রাস্তা? সেই রাস্তায় যে হাজারো আইনি জটিলতা!
তা হলে উপায়?
রবিবার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেসে চিকিৎসা ক্ষেত্রে আইনি সমস্যা নিয়ে এক আলোচনাসভায় এই প্রশ্নটাই উঠে এল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক মার্সি খাউতে বললেন, ‘‘এ দেশে সরাসরি জীবন-যষ্টি ব্যবস্থা খুলে নেওয়ার উপায় নেই। সে-ক্ষেত্রে খুন বা অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে এগোতে হলে আইনি দিক বেশ আঁটোসাঁটো করে নিয়ে এগোনোই উচিত। নইলে জটিলতা বাড়বে বই কমবে না।’’
অরুণা শানবাগের কথা স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে আলোচনায়। মুম্বইয়ের কিং এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হাসপাতালের নার্স অরুণাকে ধর্ষণ করেছিল সেখানকার কর্মী সোহনলাল। সে অরুণার গলায় কুকুরের শিকলের ফাঁস দিয়েছিল। তার ফলে অরুণার মস্তিষ্ক চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। তার পরে বেঁচে থাকলেও তাঁর শরীর কোনও কাজ করত না। অরুণার ইচ্ছামৃত্যুর আর্জি নিয়ে আদালতে যান তাঁর বন্ধু পিঙ্কি বিরানি। সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট পরোক্ষ ইচ্ছামৃত্যুকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছিল। দেশে স্বেচ্ছামৃত্যুর আইনি অনুমোদন সেই প্রথম।
আদালত বলেছে, কোনও মানুষের ব্রেন ডেথ (মস্তিষ্কের মৃত্যু) হলে বা হৃৎপিণ্ড ছাড়া দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-উপাঙ্গ বিকল হয়ে গেলে সেই সব ক্ষেত্রে লাইফ সাপোর্ট ব্যবস্থা খুলে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু চরম সিদ্ধান্তটা নেবেন কে? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না?
‘‘এ ক্ষেত্রে ‘মেডিক্যাল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ করা যেতে পারে। যেমন বিষয়সম্পত্তির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কাউকে মনোনীত করা যায় ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ দিয়ে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কাউকে মনোনীত করা যেতে পারে। ‘মেডিক্যাল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ সেটাই,’’ বললেন মার্সি।
স্বাস্থ্য আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, এই ধরনের পরিস্থিতিতে গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আদালতকে জুড়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সে-ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতিক্রমে গোটা বিষয়টি রূপায়ণ করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে নীতি কমিটিও তৈরি করা যেতে পারে হাসপাতালে। তবে গোটা বিষয়টিতে নথিপত্র যথাযথ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তাঁরা। মার্সি বলছেন, ‘‘মেডিক্যাল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ব্যবস্থার যাতে কোনও রকম অপব্যবহার না-হয়, সে-দিকেও বিশেষ ভাবে নজর রাখা উচিত।’’
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সংক্রমণের জেরেও বিপদে পড়তে হয় বহু রোগীকে। অনেক সময়েই দেখা যায়, কোনও শারীরিক অসুস্থতার জন্য রক্ত নিতে হলে তার থেকে হেপাটাইটিস বা অন্য কোনও রোগের জীবাণু শরীরে ঢুকে পড়ে। এ দিনের আলোচনাচক্রে উঠে আসে এই বিষয়টিও। হেমাটোলজিস্ট সুদীপ্তশেখর দাসের মতে, এ দেশে অনেক ব্লাডব্যাঙ্কেরই উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। তার ফলে বহু ক্ষেত্রে রক্ত থেকে শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি জানান, বেশ কিছু রোগের ক্ষেত্রে রক্তের নির্দিষ্ট উপাদান প্রয়োজন হয়। যেমন থ্যালাসেমিয়া বা রক্তাল্পতার ক্ষেত্রে লোহিত রক্তকণিকা প্রয়োজন হয়। ডেঙ্গির ক্ষেত্রে আবার দরকার পড়ে প্লেটলেট বা অণুচক্রিকার। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে অনেক সময়েই বাধ্য হয়ে পুরো রক্ত রোগীর শরীরে দিয়ে দিতে হয়। কারণ, কোনও রোগীর চিকিৎসায় রক্তের যে-বিশেষ অংশটি দরকার, পরিকাঠামো না-থাকায় রক্ত থেকে সেই অংশটাকে আলাদা করে নেওয়া যায় না। এ ভাবে অপ্রয়োজনীয় অংশ-সহ পুরো রক্ত শরীরে দেওয়ার জেরেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় বলে জানান সুদীপ্তবাবু। তিনি মনে করেন, এই ব্যাপারেও আইনি দিকটা যথেষ্ট জোরালো করে তোলা প্রয়োজন।
অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়েও আইনি জটিলতার শেষ নেই। বছরখানেক আগে কলকাতাতেই একটি কিডনি পাচার চক্রের হদিস পেয়েছিল পুলিশ। তার পরে অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে আইনি জটিলতা গড়ায় কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত। নেফ্রোলজিস্ট অরূপরতন দত্ত এ দিনের আলোচনাসভায় জানান, অনেক সময়েই দেখা যায়, রোগীর রক্তের গ্রুপ তাঁর আত্মীয়ের সঙ্গে মিলছে না। তবে প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় থাকা অন্য কোনও রোগীর সঙ্গে সেই আত্মীয়ের রক্তের গ্রুপ মিলে যাচ্ছে। আবার দ্বিতীয় রোগীর আত্মীয়ের সঙ্গে রক্তের গ্রুপ মিলছে প্রথম রোগীর। এই পরিস্থিতিতে এক রোগীর আত্মীয়ের কিডনি আপসে অন্য রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। এই ব্যবস্থার আইনি স্বীকৃতিও রয়েছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্রেন ডেথ হয়ে যাওয়া রোগীর দান করা অঙ্গও অন্যের দেহে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব বলে চিকিৎসকদের অনেকে জানান।