ফাইল চিত্র।
সেলোটেপ মেরে বিশেষ পদ্ধতিতে বিপুল টাকা প্যাকেটবন্দি করে রাখার প্রক্রিয়ার মধ্যেই হাওয়ালার গন্ধ পাচ্ছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি। স্কুলশিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় ধৃত প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী (এখন শিল্পমন্ত্রী) পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ডায়মন্ড সিটির ফ্ল্যাটে পাওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা হাওয়ালার মাধ্যমে পাচার করার জন্য তৈরি রাখা হচ্ছিল বলে তদন্তকারীদের দাবি। তাঁরা জানান, আচমকা তল্লাশি অভিযান চালানোয় ওই টাকা ধরা পড়ে গিয়েছে। এর আগেও অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে মোটা টাকা পাচার হয়েছে বাইরে।
দুর্নীতি কাণ্ডের এই টাকা হাওয়ালার মাধ্যমে বিদেশে পাচারের কয়েকটি সম্ভাব্য সূত্র উঠে এসেছে বলেও জানান তদন্তকারীরা। তাঁদের দাবি, অর্পিতার বাড়িতে পাওয়া কিছু নথি দেখে মনে করা হচ্ছে, কয়েক জন বিদেশি ব্যবসায়ীর সঙ্গে অর্পিতার যোগাযোগ ছিল। তিনি নিজেও কয়েক বার বিদেশে গিয়েছেন। অর্পিতার ফ্ল্যাটে পাওয়া টাকার একটি বড় অংশ যে-ভাবে সেলোটেপ মেরে বান্ডিল করে রাখা ছিল, তা দেখে এক তদন্তকারী জানান, হাওয়ালার মাধ্যমে টাকা পাঠানোর সময় এমন ভাবেই সেলোটেপ মেরে প্যাকেট তৈরি করা হয়। সেই কারণে এক দিকে টাকা প্যাকেট করার প্রক্রিয়া, অন্য দিকে বিদেশি ব্যবসায়ীদের যোগসূত্র— এই দু’টি বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।
তদন্তকারীদের অনুমান, ওই ফ্ল্যাটে আরও অনেক টাকা ছিল। ধীরে ধীরে তা সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। ইডি-র ব্যাখ্যা, আলমারি থেকে সামান্য কয়েক লক্ষ টাকা উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু ঘরের এক পাশে মোটা কাগজে সেলোটেপ মারা একাধিক প্যাকেট থরে থরে সাজানো ছিল। একটি প্যাকেট খোলার পরেই দেখা যায়, তাতে টাকা রয়েছে। তার পরে একের পর এক প্যাকেট খোলায় ৫০০ এবং ২০০০টাকার নোটের বান্ডিল বেরিয়ে আসতে থাকে। দীর্ঘ জেরায় অর্পিতার দাবি, ওই টাকা ফ্লাটে রাখা থাকলেও তা তাঁর নয়। ইডি-র দাবি, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী যে নিয়মিত তাঁর ফ্ল্যাটে আসতেন, সে-কথা জেরায় কবুল করেছেন অর্পিতা।
ইডি-র দাবি, শুধু টাকা নয়, চাকরির সুপারিশও নাকি সরাসরি পৌঁছে যেত অর্পিতার ডায়মন্ড পার্কের ফ্ল্যাটে। ‘ঘুরপথে’ যাঁরা চাকরি চাইতেন, তাঁরা সরাসরি অর্পিতার কাছে টাকা পাঠাতেন লোক মারফত।
তদন্তকারীদের দাবি, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তরফে শিক্ষকপদে নিয়োগের জন্য নামের যে-তালিকা পাঠানো হত, তা-ও পৌঁছত ডায়মন্ড পার্কে অর্পিতার ফ্ল্যাটে। চাকরির মান অনুযায়ী অগ্রিম টাকা নেওয়া হত। পরে চাকরি পাকা হলে নেওয়া হত বাকি টাকা। ইডি-র দাবি, অর্পিতাকে জেরা করেই নাকি এই তথ্য উঠে এসেছে। তাঁর ফ্ল্যাট থেকে বিভিন্ন চাকরিপ্রার্থীর নামের তালিকাও উদ্ধার হয়েছে বলে জানান তদন্তকারীরা। ইডি-র দাবি, প্রাথমিক ভাবে যে-সব তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, তার ভিত্তিতে অনুমান করা হচ্ছে, এক-একটি চাকরি বিক্রির বিনিময়ে আট থেকে ১০ লক্ষ টাকা নেওয়া হত।
ইডি শনিবার জানিয়েছিল, অর্পিতার ফ্ল্যাটে পাওয়া গিয়েছে প্রায় সাড়ে ২২ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকা গোনার ক্ষেত্রে কিছু ভুল হয়ে থাকতে পারে। রবিবার আদালতে ইডি-র দাবি, ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া টাকার অঙ্ক ২১ কোটি ৯০ লক্ষ।
তদন্তকারীদের অনুমান, শুধু পার্থবাবু ও অর্পিতাই যে এই কাণ্ডে যুক্ত, তা নয়। বেআইনি ভাবে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র হয়েছে। আরও বেশ কয়েক জন প্রভাবশালী এই দুর্নীতিতে জড়িত বলে গোয়েন্দাকর্তাদের দাবি। তাঁরা জানাচ্ছেন, পার্থবাবু ছাড়াও আরও অনেক প্রভাবশালী এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠদের যাতায়াত ছিল ওই ফ্ল্যাটে। এক ইডি-কর্তা বলেন, ‘‘টাকা পাচার-সহ দুর্নীতিতে মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ আধিকারিক, কর্তা-সহ আরও কে কে জড়িত, তা জানতে অর্পিতার ২০টি মোবাইল ফোন মুশকিল-আসান হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছি আমরা।’’
ইডি জানিয়েছে, ওই সব ফোনের সিম কার্ডের ভিত্তিতে সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। সিম কার্ড ঢোকানোর পরে কোন কোন নম্বরে ফোন করা হয়েছে এবং কোন কোন নম্বর থেকে ফোন এসেছে, তার কল রেজিস্টার রিপোর্ট সরবরাহ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে সার্ভিস প্রোভাইডারকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তে ওই সব মোবাইল থেকে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নম্বরের হদিস মিলেছে বলেও তদন্তকারীদের দাবি। সে-ক্ষেত্রে দুর্নীতিতে আরও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ফুটে উঠছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। ইডি-কর্তাদের বক্তব্য, ওই সব মোবাইলের সূত্রে দুর্নীতি চক্রের অন্য চক্রীদের তথ্য সহজেই উঠে আসবে।