জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। —ফাইল চিত্র।
রেশন বণ্টন দুর্নীতিতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হদিস পাওয়া কোটি কোটি টাকার শিকড় কোথায়? তদন্তে নেমে বিস্ময়সূচক তথ্যপ্রমাণ হাতে এসেছে তদন্তকারীদের। তদন্তকারী সংস্থার একটি সূত্রের দাবি, শুধু সংস্থার মাধ্যমেই দুর্নীতির টাকা বিনিয়োগ করা হয়নি। রেশন দুর্নীতিকাণ্ডে নগদ লেনদেনও হয়েছে দেদার। সেই লেনদেনের ‘সেফ প্যাসেজ’ ছিল রাজ্য সরকারের খাদ্য দফতরই। অর্থাৎ, খোদ খাদ্য দফতরের মধ্যেও অর্থের হিসেবনিকেশ হয়েছে বলে দাবি ওই সূত্রের। রেশন দুর্নীতির তদন্তে একাধিক ব্যক্তিকে জেরা করে ওই তথ্য মিলেছে বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা।
গত পাঁচ দিন ধরে ইডির হেফাজতে রয়েছেন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক (বালু)। ইতিমধ্যেই প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীর যোগ থাকা একাধিক সংস্থা এখন ইডির আতশকাচের তলায় রয়েছে। তিনটি সংস্থায় শেয়ার প্রিমিয়ামের মোড়কে প্রায় ১২ কোটি টাকা বিনিয়োগের হদিস পেয়েছেন তদন্তকারীরা। পাশাপাশি, তাঁর কন্যা এবং স্ত্রীর সঙ্গে একদা যোগ-থাকা তিনটি সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রায় আট কোটি টাকা জমা করা হয়েছিল বলেও জানতে পেরেছেন তাঁরা। তদন্তকারী সংস্থার দাবি, ওই টাকার প্রায় ৯০শতাংশ জমা করা হয়েছিল নগদে! একই ভাবে রেশন দুর্নীতিতে গ্রেফতার বাকিবুর রহমানের স্ত্রী এবং শ্যালকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেও কয়েক কোটি টাকা লেনদেনের হদিস পেয়েছেন তাঁরা। টাকার হিসাব পাওয়া গিয়েছে ইডির তল্লাশিতে বাজেয়াপ্ত হওয়া ডায়েরি এবং নোটবইয়েও। তাই ওই সব নগদ টাকা কার কাছ থেকে, কোন পথে এবং শেষ পর্যন্ত কার কাছে গিয়ে পৌঁছেছে, সেই অঙ্ক মেলানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। ওই নগদ লেনদেনের তদন্ত করতে গিয়েই একেবারে খাদ্য দফতরের মধ্যেই টাকার হাতবদলের বিষয়টি তাঁরা জানতে পেরেছেন বলে ইডি সূত্রের খবর।
গত ১৪ অক্টোবর বালু-ঘনিষ্ঠ বাকিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে ইডি। বাকিবুরের পাশাপাশি আরও একাধিক ব্যক্তিকেও রেশন দুর্নীতিকাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন তদন্তকারীরা। বাকিবুরকে জেরা করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২৬ অক্টোবর বালুর বাড়ি-সহ একাধিক জায়গায় তল্লাশি চালায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তাদের অভিযোগ, রেশন দুর্নীতি থেকে আর্থিক দিক দিয়ে ‘লাভবান’ হয়েছেন বালু। মন্ত্রীর গ্রেফতারির পর তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের পাশাপাশি বর্তমান এবং প্রাক্তন আপ্তসহায়ককেও তলব করে বয়ান লিপিবদ্ধ করেছে ইডি। খাদ্য দফতরের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বয়ানেই দফতরের মধ্যে লেনদেনের বিষয়টি ইডির কাছে উঠে এসেছে। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, মাসের বিভিন্ন সময়ে ব্যাগে ভরা টাকা খাদ্য দফতরে এসে পৌঁছত। ওই বিষয়ে বালুর কাছে তদন্তকারীরা আরও তথ্য জানতে চাইছেন।
২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বালুই ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী। ইডির দাবি, খাদ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে ইডির হাতে ধৃত ব্যবসায়ী বাকিবুরের ‘দুর্নীতি’র টাকার ভাগ পৌঁছেছিল বালুর কাছে। তবে শুধু বাকিবুর নন, আরও বেশ কিছু ব্যবসায়ীদের তরফে আসত নগদ টাকা। তার পরিমাণ হাজার থেকে লাখের মধ্যে ঘোরাফেরা করত বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। ওই টাকা যেমন দফতরের মাথায় পৌঁছেছে, তেমনই বাদ যাননি বিভিন্ন ছোট-বড় ‘বাবু’। ছোট-বড় বিভিন্ন মাপের ব্যবসায়ীরা ওই ভাগের টাকা খাদ্যভবনে পৌঁছে দিতেন বলে ইডি তদন্তে নেমে জানতে পেরেছে।
তদন্তে নেমে বাকিবুর এবং এক ব্যক্তির হোয়াট্সঅ্যাপে কথাবার্তা কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের হাতে এসেছে। সেখানেই মন্ত্রীকে টাকা দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে বলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি। ইডির দাবি, ২০২০ সালে ‘এমআইসি’কে ৬৮ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা আরও জানিয়েছে, বাজেয়াপ্ত করা ফোনের হোয়াট্সঅ্যাপ বার্তায় ‘এমআইসি’কে আরও ১২ লক্ষ টাকা দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। ‘এমআইসি’ সাধারণত বলা হয়ে থাকে ‘মিনিস্টার-ইন-চার্জ’কে। এ ক্ষেত্রে ‘এমআইসি’ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় বলেই জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। ওই টাকাও কী ভাবে লেনদেন হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
এর আগে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তে নেমেও ইডির হাতে এমনই তথ্য এসেছিল। তদন্তকারী সংস্থা দাবি করেছিল, নিয়োগ দুর্নীতিতেও টাকার লেনদেন হয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অফিস চত্বরে। কোন ভরসায় দুর্নীতির টাকা লেনদেনের জন্য সরকারি দফতরকে নিশ্চিন্তে ব্যবহার করা হত, তা ভেবে খানিকটা বিস্মিতও তদন্তকারীরা।