গ্রাস করছে বিষাদ ফাইল চিত্র
প্রথম টিকা নিয়েছিলেন। তার পরেও চার দিনের জ্বরে চলে গেলেন মা। বাবা আর বর এবং মেয়েটি নিজেও তখন কোভিডে কাবু। বাবাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরানোর পরে সেবাযত্নের ত্রুটি হতে দেবেন না বলে বদ্ধপরিকর ছিলেন সঙ্গীতা। সদ্য স্ত্রীকে হারানো ভঙ্গুর মানুষটি তাঁকে সেই সুযোগ দিলেন না।
দিন দশেকের মধ্যেই বাবার জ্বরটা ফিরে আসে! আবার হাসপাতালে দৌড়োদৌড়ি। বাবার দ্রুত কোমার গহনে ডুবে যাওয়া। সব কিছুই চোখের পলকে ঘটে গেল। মৃত্যু আকস্মিক, জানা ছিল। তা বলে ঝড়ের গতিতে দু’-দু’টি জলজ্যান্ত মানুষ মুছে যাবেন! ভাবতে পারছেন না বারাসতের সঙ্গীতা বাগচী। মধ্য তিরিশের কর্পোরেট কর্মী ম্লান হাসেন, “বীরভূমের গ্রাম থেকে জোরাজুরি করে না-আনলে মা-বাবা হয়তো বহাল তবিয়তেই থাকতেন।” মাত্র ৬৫ আর ৬৩ বছরে দু’টি জীবন ঝরে যাওয়ার নিষ্ঠুরতা মানতে পারছেন না তিনি।
৮৩ বছরের রীতেন্দ্রনাথ সরকার এবং ৮১ বছরের তৃপ্তি সরকারও সদ্য চলে গিয়েছেন দু’মাসের ব্যবধানে। দমদমের ক্রাইস্টচার্চ স্কুলের শিক্ষিকা তৃপ্তিদেবী কোভিডকে হারিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। পুত্র রীতেশ বললেন, “বাবাকে ছাড়া মায়ের বাঁচার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছিল! কিন্তু পরপর দু’জনকেই হারাব, ভাবতে পারিনি!”
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় তছনছ বহু পরিবার। মা-বাবা দু’জনকে হারিয়ে কার্যত অনাথ কত শিশু। কিন্তু পরিণত বয়সেও অল্প দিনের ব্যবধানে মা-বাবা দু’জনকে হারানোর আঘাত খুব সহজ নয় সহ্য করা! গত নভেম্বরে কোভিডে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন চলে যান, তাঁর স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়ও অন্য দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছিলেন। আর ছ’মাসও বাঁচেননি তিনি। গত এপ্রিলের শেষে আট দিনের ব্যবধানে কবি শঙ্খ ঘোষের পরেই চলে যান তাঁর স্ত্রী প্রতিমাদেবীও। এক দিনের ব্যবধানে বাবা ও মাকে হারিয়েছেন দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী মিশনারি স্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা।
গড়িয়াহাটের বাসিন্দা মধ্য চল্লিশের সরকারি কর্মচারী যুবক গত বছর মে-র গোড়ায় বাবাকে এমআর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। মায়ের কোভিড ধরা পড়ে পরে। কিন্তু তিনিই আগে গত হয়েছেন। তার দিন দশেকের মধ্যে চলে যান বাবা। এই প্রবল মানসিক টালমাটালের সময়ে ওই যুবক আর্থিক ভাবে স্ত্রীর কাছে প্রতারিত হয়েছেন বলেও অভিযোগ।
সংস্কৃতিগত ভাবে এ দেশের অনেকের কাছেই বাবা বা মায়ের মৃত্যু মানে মহাগুরু নিপাত। পিতৃমাতৃ বিয়োগের পরে সংস্কারবশে সাবধানে থাকতে বলেন সুহৃদজন। পরের একটি বছর কালাশৌচ। কোথাও যাওয়া বা খাওয়া নিয়ে পদে পদে নিষেধ। “মা, বাবা দু’জনকে পরপর হারিয়ে অনেকেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এর পিছনে আছে নানা সামাজিক সংস্কার,” বলেন মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, “কোভিডের সময়ে বাড়তি যন্ত্রণা হল শেষ ক’টা দিন মা-বাবার কাছে আসতে না-পারা। জীবনের যে-কোনও সম্পর্কই একটা নিষ্পত্তির বা ক্লোজ়ারের রাস্তা খোঁজে। কোভিডে এই প্রিয়জন বিয়োগের ব্যথায় মিশে থাকে এক ধরনের অসম্পূর্ণতার বোধও।” সৌমিত্র-দীপার মেয়ে পৌলোমী বসু বলছিলেন, “জীবনে এর আগে ছেলের দুর্ঘটনার পরেও কাজের মধ্যে ডুবে বাঁচার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাপি ও মা পরপর চলে যাওয়ার পরে কোভিডের বিধিনিষেধ যেন হাত-পা বেঁধে রেখেছে। অবসাদ থেকে বেরোনো আরও কঠিন।”